কিমিয়া থেকে কেমিস্ট্রি:
গুপ্তবিদ্যার প্রতি আগ্রহ মানুষের চিরন্তন। "আল কেমি" হচ্ছে সেই রকম গুপ্তবিদ্যা, যার দ্বারা মানুষ "এলিক্সির" নামে এমন একটি যাদুকরী বস্তু তৈরী করতে পারবে। সে এলিক্সিরের ছোয়ায় লোহা হয়ে যাবে সোনা, তামা হয়ে যাবে রূপা, আর মানুষের আয়ু যাবে বহুগুন বেড়ে!! লোহা থেকে সোনা বানানো কিংবা জীবনকে দীর্ঘায়িত করার বাসনাই ছিল আল কেমী বিদ্যার মূল উদ্দেশ্য।
"আল কেমি" শব্দটি এসেছে আরবী আল কিমিয়া থেকে। "আল" হচ্ছে "the" এর আরবী এবং "কিমিয়া" এসেছে "কেম" থেকে, যার অর্থ "কালো মাটি"। মিশরের নীল নদের তীরের মাটি কালো হওয়ায় এ নাম, কেননা "আল কেমী"র ব্যপক চর্চা মূলত হয়েছে মিশরে। তবে এ নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, গ্রীক "কায়মা" থেকেও "কেমী" শব্দটি আসতে পারে। "কেমী" শব্দের এটিমোলোজি যাই হোক না কেন, "আল কেমি"র ব্যপক চর্চা তৎকালীন মুসলিম সমাজে হবার ফলে, "আল কেমী" শব্দটির আরবীতে আত্তীকরন হয়ে যায়।
আল কেমী বহু আগে থেকে চলে আসা একটি সাবজেক্ট, পৃথিবীর মানুষ লোহা থেকে সোনা বানানোর অসম্ভব চেষ্টা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই করছে। এরিস্টটলের দর্শন অনুযায়ী, সমস্ত বস্তুই আসলে একই জাতীয় সাবস্ট্যান্স দিয়ে তৈরী - শুধু অনুপাত ভিন্ন। অনুপাতের ভিন্নতার ফলেই একটি পদার্থ হয় লোহা, আর অন্যটি হয় সোনা। আরব বিজ্ঞানী জাবেরও ছিলেন একজন আলকেমিস্ট যিনি এরিস্টটলের এই দর্শনের দ্বারা প্রভাবান্বিত ছিলেন। আর আল কেমী বিদ্যাটি কিছুটা সুপ্ত হওয়ায় জাবেরের বইগুলোও অনেকটা রূপক ভংগিতে লেখা। আল কেমির উপরে লেখা তার বই "কিতাব আল জোহরা"তে তিনি লিখেছেন,
"আল্লাহ যাদের ভালবাসেন তারা ব্যাতীত বাকীদের হতভম্ব করা এবং ভুল পথে নেয়াই এর উদ্দেশ্য। " অন্য জায়গায় জাবের লিখেছেন, "আমার "মাস্টার" আমাকে শাসাচ্ছেন, যাতে এসব বিদ্যা কোন অবিবেচকের হাতে না পড়ে। " আলকেমীর বিদ্যা গুপ্ত রাখার মানসিকতায় বইগুলো লিখেন কঠিন ভাষায় এবং সাধারনের বোধগম্যের বাইরে।
আল কেমীর চর্চা থেকেই জাবের একসময় আবিষ্কার করে ফেললেন অনেক কিছু। আবিষ্কার করেন কি করে তরলের মিশ্রন থেকে একটি তরলকে আলাদা করা যায়, যা ডিস্টিলেশন নামে পরিচিত, আবিষ্কার করেন একুয়া রেজিয়া নামে একটি মিশ্রন যা সোনাকে গলিয়ে দিতে পারে এবং উদ্ভাবন করেন অগুনতি কেমিক্যাল সাবসট্যান্স - যা মরিচা প্রতিরোধ, স্বর্নের কারুকাজ, পোশাকের ওয়াটারপ্রুফ সহ বিভিন্ন শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত হয়। আল কেমী থেকে তিনি সিস্টেমেটিক এক্সপেরিমেন্টেশনের দ্বারা শুরু করেন আরেকটি সাবজেক্ট, যা পরিচিতি পায় কেমেস্ট্রি হিসেবে। এ প্রসংগে তিনি বলেন, "কেমিস্ট্রির প্রাথমিক কর্তব্য হল, তুমি প্রাকটিক্যাল কাজ করবে এবং এক্সপেরিমেন্ট চালাবে। যারা প্রাকটিক্যাল কাজ করে না এবং এক্সপেরিমেন্ট চালায় না, তারা এ বিষয়ে কোন রকমের দক্ষতা অর্জন করতে পারে না।"
জাবের ইবনুল হাইয়ানের পরিচয় ও তার সংক্ষিপ্ত জীবনী:
৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দে খলিফা উমর ইউফ্রেটিসের পশ্চীম তীরে কুফা শহর প্রতিষ্ঠা করেন। চারিদিক থেকে ইমিগ্রান্ট এসে কুফায় বসতি শুরু করে, একসময় কুফার জনসংখ্যা ২০০০০০ ছাড়িয়ে যায়। পরবর্তীতে কুফা উমাইয়াদের প্রধান শহরে পরিনত হয়। এই কুফা শহরেই আজদী নামের এক গোত্রের একজন ছিলেন হাইয়ান, যার নেশাগ্রস্ততা শহরে বেশ পরিচিত ছিল। তিনি গোপনে উমাইয়া খলিফাদের বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত চলছিলো, তাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। ৭১২ শতকে উমাইয়া রাজবংশের জনপ্রিয়তায় এক বিশাল ধ্বস নামে। এছাড়া ব্যপক হারে অমুসলিমদের মুসলিম হওয়ার ফলে উমাইয়া রাজ্য অর্থনৈতিক মন্দার সম্মূখীন হয়। অমুসলিমদের কাছ থেকে আদায়কৃত জিজিয়া ট্যাক্সের পরিমান কমে যায়, যা রিভিনিউতে মারাত্মক ধ্বস নামায়। মুসলিমরা যাকাত দিলেও সে যাকাতের খাত নির্দিষ্ট, সর্বমোট আটটি। ফলে উমাইয়াদের পক্ষে অর্থনৈতিক ধ্বস সামলানো কঠিন হয়ে যায়।
ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আলীর নেতৃত্বে আব্বাসীয় নেতৃত্ব আসে ক্ষমতায়, যাদেরকে সক্রিয় সহযোগিতা করে শিয়া সম্প্রদায়। জাবেরের পিতা হাইয়ান, যিনি ছিলেন একজন শিয়া, এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। হাইয়ান এক পর্যায়ে উমাইয়াদের হাতে ধরা পড়ে যান এবং নিহত হন। ফলশ্রুতিতে ৭২১ খ্রীষ্টাব্দে জন্ম শিশু জাবের বড় হন পিতাকে ছাড়াই। কৈশোরে তিনি কোরান, গনিত সহ বেশ কিছু বিষয়ে পারংগমতা অর্জন করেন। আব্বাসীয় রাজবংশ অবশেষে প্রতিষ্ঠা পায়। কথিত আছে আব্বাসীয় জেনারেল আবদুল্লাহ একবার ৮০ জন উমাইয়া নেতাকে দাওয়াত করেন। উমাইয়া নেতারা যখন খেতে ব্যস্ত, তখন আবদুল্লাহ আদেশ দেন এদের হত্যা করার জন্যে। শুধু একজন জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে বেচে যান, যিনি পরে ইউফ্রেটিস পার হয়ে স্পেনে পৌছান। মোট কথা, ৭৫০ শতকের এর মধ্যেই উমাইয়াদের হঠিয়ে আব্বাসীয়রা ক্ষমতা সুদৃঢ় করে নেয়।
আব্বাসীয়রা ক্ষমতায় আসার পরে জাবির এক সময় আব্বাসীয় উজির বার্মিকীর নেক নজর লাভ করেন, যার মাধ্যমে খলিফার সাথে দেখা করতে সমর্থ হন। ইয়াহিয়া বার্মিকীর একজন অতীব সুন্দরী দাসী অসুস্থ হয়ে গেলে জাবের তাকে এলিক্সির খাইয়ে পুরো সুস্থ করে দেন (যা ছিল এক ধরনের দ্রবন)। আব্বাসীয়দের কাছে হাইয়ানের সন্তান হিসেবে তিনি স্বীকৃতি পান দুভাবে: খলিফা হারুন অর রশিদের দরবারে তিনি আল কেমিস্ট হিসেবে নিয়োগ পান এবং অন্যদিকে বিখ্যাত শিয়া আলেম জাফর ইবনে আবি তালিব তাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহন করেন। শিয়াদের কাছে আল কেমী সবসময়েই আদৃত একটি বিদ্যা ছিল। আলী (রা) বলেন, "আল কেমী হচ্ছে প্রফেসীর বোন।" খলিফার দরবারে তিনি অনেকদিন কাজ করেন। খলিফা হারুন অর রশিদ পরবর্তীতে বার্মিকীদের আচরনে মহা বিরক্ত হয়ে একজনের প্রানদন্ড ও বাকীদের বরখাস্ত করেন। তখন জাবের কুফাতে ফিরে আসেন। বার্মিকীদের সাথে সুসম্পর্ক থাকার মাশুল গুনতে হয় হাউজ এরেস্ট হয়ে। অবশেষে ৮১৫ সালে এ অবস্থাতেই তিনি মৃত্যু বরন করেন।
জাবেরের কিছু গুরুত্ববহ অবদান:
ডিস্টিলেশন হচ্ছে দুটি দ্রবনকে তাদের ভিন্ন স্ফুটনাংকের মাধ্যমে আলাদা করা। জাবির ইবনুল হাইয়ানের এই আবিষ্কার আলকেমী থেকে কেমিস্ট্রির পথে ছিল মাইলস্টোন উত্তরন। বিজ্ঞানী জাবির এক্সপেরিমেন্টেশনের উপর গুরুত্ব দেন এবং আল কেমীকে সাইন্স রূপ দিয়ে কেমিস্ট্রি হিসেবে দাড় করান। তিনি সালফিউরিক এসিড, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, নাইট্রিক এসিড, ডিস্টিলেশন, ক্রিস্টালাইজেশন, লিকুইফ্যাকশন, অক্সিডাইজেশন, ইভাপোরেশন, ফিলট্রেশন সহ বেশ কিছু কেমিক্যাল এবং তার প্রসেস ব্যখা করে যান, যা আজকের কেমিস্ট্রির ভিত্তিমূল।
বিজ্ঞানী জাবের হাইড্রোক্লোরিক এসিড এবং নাইট্রিক এসিড আবিষ্কার করে তার মিশ্রন থেকে আবার "একুয়া রেজিয়া" আবিষ্কার করেন যা সোনাকে দ্রবীভূত করে। যার ফলে সোনার বিশুদ্ধিকরন এবং আহরন সহজ হয়ে যায়। এছাড়া তিনি সাইট্রিক এসিড, এসিটিক এসিড এবং টারটারিক এসিড আবিষ্কার করেন। জাবেরের এই রসায়নের জ্ঞান বিভিন্ন শিল্প কারখানায় সফলভাবে প্রয়োগ করা হয় এবং তার ফলে অনেক ধরনের ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেস উন্নত হয়। যাদের মধ্যে রয়েছে, স্টীল প্রস্তুতকরন, মরিচা প্রতিরোধকরন, স্বর্ন খোদাইকরন, পোশাকের ডাই তৈরী এবং চামড়ার ট্যানিং। তিনি গ্লাস তৈরীতে ম্যাংগানিজ ডাই অক্সাইড ব্যবহার বিধি দেখান, যা আজকের দিনেও ব্যবহৃত হয়। তার এসব আবিষ্কার আজকের কেমিস্ট্রি এবং কেমিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং এর ভিত্তিমূল।
জাবেরিয়ান করপাস:
জাবেরের গ্রন্থের পরিমান এত বেশী যে ধারনা করা হয় একা জাবেরের পক্ষে এতগুলো বই লেখা অসম্ভব। জাবেরের পরবর্তি কালে জাবেরের নামে ইসমাইলিয়া সম্প্রদায় এসব বইয়ের কিছু অংশ লিখতে পারে বলে মনে করা হয়। জাবেরের গ্রন্থ সমগ্রকে চার ভাগে ভাগ করা যায়:
১। আত্মিক আলকেমি: এ বিষয়ে প্রায় ১১২ টি বই রয়েছে যা বার্মিকি উজিরদের উৎসর্গ করে লেখা।
২। দর্শন : ১০ টি বই রয়েছে পিথাগোরাস, সক্রেটিস, এরিস্টটল ও প্লেটোর দর্শনকে ব্যাখা করে। জাবের তার লেখায় গ্রীক ও মিশরীয় আলকেমিস্টদের প্রতি শ্রদ্ধা ব্যক্ত করেছেন।
৩। ৭০টি বই রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ের উপরে।
৪। আরো কিছু বই রয়েছে "ব্যালেন্স অব ন্যাচারের" উপরে।
কারো পক্ষে এত বই লেখা কি করে সম্ভব? তাই, ধারনা করা হয়, জাবেরের অনুসারীরা হয়তবা তার নামে কিছু বই লিখে রেখেছে। এ নিয়ে এখনো গবেষনা চলছে।
আগেই বলেছি, জাবেরের অনেক বই আল কেমির প্রথা অনুযায়ী খুব রহস্যের ভংগিতে লেখা। জাবেরের স্ক্রীপ্টের এই গুপ্ত ভাব থেকে ইংরেজীতে "gibberish" শব্দটি এসেছে। যার অর্থ "যা বোধগম্য নয়।"
জাবের প্রসংগে ফেইথ ফ্রিডমের ভন্ডামি:
ফেইথ ফ্রিডম সাইটের কথা আপনারা শুনেছেন কিনা জানিনা। ইসলামের উপর তিতা বিরক্ত হয়ে যারা ইসলাম পরিত্যাগ করেছেন, তাদের মিলন মেলা হল এই সাইট। কে ইসলাম ত্যাগ করল, এটা আমার কাছে খুব বড় কোন ইস্যু নয়। ইসলাম একই সাথে বিশ্বাস এবং আচার সমৃদ্ধ একটি ধর্ম। এই বিশ্বাসকে অস্বীকার করে কেউ ইসলাম ত্যাগ করতে চাইলে সে অধিকারটুকু তার থাকা উচিত। মানুষের বিশ্বাসের স্বাধীনতার এই বিষয়টি মুসলিমদের স্বীকার করে নেয়া উচিত। এতে ক্ষতির কিছু নেই, বিশেষত যেখানে পৃথিবীতে ইসলাম গ্রহনের হার তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশী। এছাড়া পবিত্র কোরানেও বিশ্বাসের স্বাধীনতার বিষয়টি অনেকবার এসেছে।
তবে ফেইথ ফ্রীডমের ক্ষেত্রে কথা হল: যতটা না সত্য, তার চেয়ে বেশী বিদ্বেষ দিয়ে পরিচালিত এই সাইট। এই বিদ্বেষ শুধু সাধারন ভাবে ইসলামের বিশ্বাস এবং আচারের বিরুদ্ধে নয়, বরং মুসলিমদের গৌরবময় ঐতিহ্য বিচারের ক্ষেত্রেও। আমি রসায়নবিদ জাবিরকে নিয়ে লেখার সময় গুগলে একটা সার্চ দেই। অনেক সাইটের মধ্যে ফেইথ ফ্রিডম ছিল একটি, যেখানে জাবের প্রসংগে নীচের কথাগুলো রয়েছে:
"Muslim apologists claim that Jabir Ibn Haiyan was the father of chemistry though Chemistry was practiced from ancient ages. Egyptians used distillation process in 3000 years BC and the Greeks in 1000 BC. Zosimus of Panopolis wrote "The Divine Art of Making Gold and Silver", in the 4th century. Jabir Ibn Haiyan should not be called the founder of Chemistry, which is nothing but the usual deceiving technique of Muslim apologists."
মোদ্দা কথা, জাবেরকে কেন প্রাচীন রসায়নের জনক বলা হবে, সেটাই তাদের কাছে বিষ্ময়। এটা নাকি মুসলিমদের ভন্ডামির আরেকটি পরিচয়!!!!
আমি এ বিষয়ে প্রথমে বলতে চাই যে, জনক শব্দটি কিছুটা আপেক্ষিক। জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতির বিষয়টি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়াতে কেউ হয়ত কোন আইডিয়া প্রথমে দেন, আবার কেউ বা তার উপর ব্যপক কাজ করে পৃথিবীর কাছে তা পরিচিত করেন। ফলশ্রুতিতে অনেক সময় দেখা যায়, যার কাজের মাধ্যমে পৃথিবী পরিচিত হয় একটি নূতন বিষয়ে, তাকেই "জনক" উপাধি দেয়া হয়। যার ফলে "জনক" শব্দটি নিয়ে রয়েছে ব্যপক বিতর্ক। তবে ফেইথ ফ্রিডম যে দাবীটা করেছে যে, জাবিরকে রসায়নের জনক বানানোটা মুসলিমদের আরেকটা ভন্ডামি - সেটা সম্পূর্ন অসত্য। জাবির তার অবদানের মাধ্যমেই পৃথিবীর সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হয়েছেন। উইকিপিডিয়াতে (Click This Link) তাকে প্রাচীন রসায়নের জনক বলা হয়েছে তার কাজকে মূল্যায়ন করেই। জাবেরকে রসায়নের জনক স্বীকৃতি দিয়ে এরকম শত সহস্র লেখা পাওয়া যাবে যার উপর মুসলিমদের কোন প্রভাব নেই। সুতরাং ফেইথ ফ্রিডমের এসব কথা শুধুই বিদ্বেষ প্রসূত, মনের জ্বালা মেটানোর ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র।
জাবিরের অবদান অবশ্য ফেইথ ফ্রিডম অস্বীকার করেনি। কিন্তু জাবিরকে তারা নন-প্রাকটিসিং মুসলিম বলে দাবী করে, প্রশ্ন উঠিয়েছে, "জাবেরের ধর্মীয় চেতনার সাথে একমত না হওয়া সত্ত্বেও মুসলিমরা কেন জাবেরকে নিয়ে গৌরব বোধ করে এবং তাকে মুসলিম বিজ্ঞানী হিসেবে দাবী করে?"
জাবেরকে নিয়ে মুসলিমরা গৌরব বোধ করার মূল কারন রসায়ন শাস্ত্রে জাবেরের অবদান। আর শুধু মুসলিমরাই গর্ব বোধ করেছেন, এই দাবীও পুরো সত্য নয়। যা হোক, মূল প্রসংগ হচ্ছে: ফেইথ ফ্রিডমের দাবী জাবের আসলে মূলধারার মুসলিম ছিলেন না - এটা কতটুকু সত্য?
জাবের ৮০০ শতকের একজন বিজ্ঞানী। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তার সম্পর্কে খুব নিশ্চিত করে কিছু জানা যায় না। জাবেরের বিষয়ে যে বিষয়টি ইতিহাসবিদদেরকে সন্দিহান করে তুলেছিল তা হল জাবেরের রেখে যাওয়া বিশাল গ্রন্থভান্ডার। এত গ্রন্থ একজনের পক্ষে লেখা কি আদৌ সম্ভব - এই প্রশ্ন থেকেই জাবের হয়ে থাকেন এক রহস্যাবৃত ব্যক্তি। ধীরে ধীরে নিরন্তর গবেষনার ফলে জাবের সম্পর্কিত রহস্যের জট খুলতে থাকে। জাবেরের গ্রন্থের পাশাপাশি ল্যাবরেটারী এবং সেখানে রাখা মর্টার পাওয়া যায়। ইতিহাসবিদরা এসব নিদর্শন থেকে ঘটনাপ্রবাহের সূতো গাথতে থাকেন। কিন্তু সে ইতিহাস কখনই অনিশ্চয়তার ছাপমুক্ত ছিল না। যতটুকু জানা যায় তাতে জাবেরের মূলধারার ইসলামের প্রতি আসক্তি ও বিশ্বাস বেশ ভাল ভাবেই ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। জাবের ছিলেন প্রখ্যাত শিয়া ফকীহ এবং ইমাম জাফর সাদিকের শিষ্য (http://en.wikipedia.org/wiki/Ja'far_al-Sadiq)। জাবেরের লেখা গ্রন্থে ইমাম জাফর সাদিককে "মাস্টার" বলে সম্বোধন করা হয়েছে। জাফর সাদিক শিয়া হলেও সুন্নীদের মাঝে গ্রহনযোগ্য ইসলামী ব্যক্তিত্ব। জাফর সাদিকের শিষ্যের মধ্যে রয়েছেন ইমাম আবু হানিফা, যিনি সুন্নীদের হানাফী মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা, মালিক ইবনুল আনাস, যিনি মালিকি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং ওয়াসিল ইবনুল আতা, যিনি মুতাজিলা মতবাদের জনক। ইমাম জাফর সাদিক মতবাদের উপরে সর্বস্তরের কাছে গ্রহনযোগ্য একজন ব্যক্তিত্ব। সেজন্য শিয়া মতবাদের হওয়ার জন্য কেন জাবের ইবনুল হাইয়ানকে সাধারন মুসলিমদের থেকে ভিন্ন মতাদর্শের হতে হবে, তা বোধগম্য নয়। শিয়াদের বিভিন্ন বইতে জাবেরকে ইমামের একজন ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে দেখানো হয়েছে। একজন নন-প্রাকটিসিং মুসলিম কেনই বা ইমাম জাফর সাদিকের মত একজন উচুস্তরের ইসলামী ব্যক্তিত্বের ঘনিষ্ঠ ও স্থায়ী সাহচর্য পাবে, সেটা মোটেও বোধগম্য নয়। সুতরাং ফেইথ ফ্রিডম কিসের উপর ভিত্তি করে জাবেরকে ভিন্ন চেতনাধারী দাবী করছে, তা বোঝা গেল না।
একটা ব্যাখা হতে পারে ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের দ্বারা জাবের ব্যবহৃত হয়েছেন। জাবেরের নাম করে ইসমাইলিয়ারা নিজেদের লেখা চালিয়েছে। সেজন্য মনে হতে পারে জাবের বুঝি ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের একজন। কিন্তু সেটা তো অসম্ভব, কারন ইসমাইলিয়া মতবাদের জন্ম হয়েছে জাবেরের পরবর্তী কালে। এছাড়া যেসব বই জাবেরের লেখা বলে ধারনা করা হয়, তাতে কোথাও ইসমাইলিয়া বা সে জাতীয় মতবাদের প্রভাব দেখা যায় না। জাবের শিয়া ছিলেন, যিনি ইমাম জাফর সাদিকের ঘনিষ্ঠ সহচর - ইতিহাস সেদিকেই জোরালো ইংগিত দেয়। কিছুটা সুফী ভাব জাবেরের মধ্যে ছিল, তবে এটাও সম্ভবত ইমাম জাফর সাদিকের প্রভাবে প্রভাবিত হবার জন্যে। তবে জাবেরের ধর্ম দর্শন নয়, ইসলামী জ্ঞানচর্চা নয়, বরং মূল অবদান রসায়ন শাস্ত্রে - সেটা অনস্বীকার্য।
=========================================
Wednesday, November 25, 2009
Tuesday, November 17, 2009
About education policy
শিক্ষা নীতি নিয়ে বেশ আলোচনা দেখছি। বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে নূতন শিক্ষা নীতি করার তোড় জোড় চলছে। সে বিষয়ে বিভিন্ন জ্ঞানী গুনী বিভিন্ন রকম বক্তব্য রাখছেন। সামহোয়ার ব্লগও তার বাইরের কিছু নয়। তাই এখানেও এ বিষয়ে নানা পোস্ট দেখছি।
আমারও কিছু কথা বলতে ইচ্ছা করে। কম্পিউটারের সামনে বসে থাকলে বার বার ইচ্ছে করে ব্লগ সাইটে উকি দিতে। মাঝে মাঝে অন্যের পোস্টে মন্তব্য করি, তবে সবসময় সে অভিজ্ঞতা সুখকর হয় না। মানুষের সাথে মেলামেশায় আমার খুব সুনাম সমাজে নেই, ব্লগেও এটা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুই বছরের উপরে আমার এখানে বিচরন, অথচ শুভাকাংখী ব্লগার বলতে নাহিদ, সোহায়লা, কিংবা পারভেজ ভাই এর মত দুই চারজন হাতে গোনা। আমি তো কোনদিনও কারো আত্ম সম্মানে আঘাত করি না, ডেল কার্নেগীর বন্ধু বিষয়ক বই অনাগ্রহ, বিতৃষ্ণা নিয়ে পড়ি শুধুমাত্র বন্ধুবৎসল হবার জন্যে, কিন্তু তবুও আজতক বন্ধুহীন হয়েই রইলাম। যার নয়ে হয় না, নব্বইতেও সে না হবার দলেই থাকে।
শিক্ষা নীতি নিয়ে কথা বলতে এসে নিজের প্রসংগে এত গুলো কথার অবতারনার কারন একটিই। আমি বাংলাদেশের প্রস্তাবিত শিক্ষা নীতি নিয়ে খুব বেশী কিছু জানি না, অথচ এ নিয়ে পোস্ট দিতে চাই। প্রেম ভালোবাসা টাইপ পোস্ট দেবার ক্ষমতা আমার নেই, তার জন্য রোমান্টিক মননশীলতার দরকার, যা আমার কোন কালেই ছিল না। কিন্তু শিক্ষানীতির বিষয়ে জ্ঞান না থাকলেও, শিক্ষার বিষয়ে আগ্রহটুকু আছে। যার ফলে পোস্টে হয়ত এ বিষয়ে নিজের এলোমেলো ভাবনাগুলো তুলে ধরা আমার পক্ষে অসম্ভব হবে না।
প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি নিয়ে কথা বলতে আমার আগ্রহের কারন আমার নিজের শৈশব বেলার অভিজ্ঞতা। জীবনের মেটামরফোসিস বিশ্লেষন করলে দেখা যায় মানুষের সবচেয়ে ভাবনাহীন আলোকিত সময়টি হচ্ছে তার শৈশব - যে সময়টা মানুষ থাকে সবচেয়ে বেশী স্বাধীন এবং উৎফুল্ল। সে সময়টাতে তাকে শেখাতে হয় আনন্দের সাথে। একবার যদি শেখার আনন্দ থেকে বিচ্যুত হয়ে সে নিরানন্দতার সাথে জুটি বাধে, তবে সে শিক্ষার সাথে পরবর্তীতে একাত্ম হওয়া তার পক্ষে কঠিন।
প্রথমেই বলে রাখছি, আমি বিভাজনমূলক শিক্ষার সমর্থক। আমেরিকার এই বিভাজন মূলক শিক্ষা ব্যবস্থার যে ভাল দিকটি আমার কাছে ফুটে উঠেছে তা হল, এর ফলে শিশুদের শিক্ষিত হবার সুব্যবস্থা অনেক বেশী থাকে। উদাহরন স্বরূপ বলা চলে, এদের একটি স্বীকৃত শিক্ষা ব্যবস্থা হল হোম স্কুলিং। অনেক পিতামাতা পাবলিক স্কুলে সন্তানদের দিতে চান না, কিংবা দেবার অবস্থায় থাকেন না। তারা স্বচ্ছন্দে নিজেদের সন্তানদের হোম স্কুলিং করিয়ে থাকেন। পাবলিক স্কুল ফ্রী, তবে ডিসিপ্লিনের জন্য অনেকে প্রাইভেট স্কুলে অনেক টিউশন দিয়ে বাচ্চাদের পড়িয়ে থাকেন। ক্যাথলিক স্কুল কিংবা অন্যান্য ধর্মীয় স্কুল গুলোও সগৌরবে টিকে আছে তাদের পরিবেশ ও ডিসিপ্লিনের কারনে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে বিষয়টি আমার কাছে উদ্বেগজনক মনে হয়েছে, তা হল পাশের হার। এখনও পাশের হার শতকরা ৫০ ভাগের বেশী নয়। তার মানে অর্ধেকেরও বেশী ছাত্র ছাত্রী তাদের কাংখিত লক্ষ্যে পৌছুতে সক্ষম নয়।
এই বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা নীতিতে জোর দেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। এই ৫০ ভাগ ছাত্র ছাত্রী কি জন্য পিছিয়ে আছে। এদেরকে কি করে সামনে এগিয়ে আনা যায়? এরা কি কারনে শিক্ষা কারিকুলামের মূল সুরটি ধরতে ব্যর্থ? পাশ্চাত্যের উদাহরন টানা যাক। পাশ্চাত্যে শিক্ষার মান মোটামুটি উন্নত। কোন সাবজেক্টে কোন ছাত্র ছাত্রী পিছিয়ে থাকলে, স্কুল থেকে তার জন্য আলাদা টিউটরিং এর ব্যবস্থা রাখা হয়। এছাড়া তাদের টেক্সট বইগুলো সহজ ভাষায় লেখা, ছবি সমৃদ্ধ এবং সিলেবাস খুব একটা বিস্তৃত নয়। যার ফলে ছাত্র ছাত্রীদের পক্ষে একটা ন্যুনতম মান অর্জন করা খুব কঠিন হয় না। বাংলাদেশে কেন তবে তা এত কঠিন? তার কারন, শিক্ষক ছাত্রের উচু অনুপাতের ফলে ছাত্রের জন্য একজন শিক্ষকের প্রয়োজনীয় সময় প্রদানে অক্ষমতা, সিলেবাসের ব্যপকতা, টেক্স্ট বইগুলো দুর্বোধ্য ভাষা এবং সবশেষে একটি বিষয়কে সহজ ভাবে উপস্থাপনায় শিক্ষকের ব্যর্থতা। মূলত এই কারন গুলোই ছাত্র/ছাত্রীদের ব্যর্থতার জন্য দায়ী। ছাত্র ছাত্রীদের কাছে শিক্ষাকে সহজবোধ্য আর আনন্দময় করে তোলা যে কোন শিক্ষা নীতিতে সবচেয়ে বেশী অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। যার অবধারিত কনসিকুয়েন্স হচ্ছে পাশের হার বেড়ে যাওয়া। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখেছি শিক্ষা নীতি যখন আলোচিত হয়, তখন এই বিষয়টিকে খুব একটা জোর দিতে দেখা যায় না। ধরে নেয়া হয়, ফাকিবাজ হলে তার পক্ষে অকৃতকার্য হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু ফাকিবাজ হবার ছিদ্র গুলো বন্ধ করতে চাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। আমাদের ছেলেমেয়েদের সবাইকে কেন এত এত বেশী বই পড়তে হবে, আর এত বেশী জানতে হবে? দিন না, জেনারেল সিলেবাস একটু কমিয়ে। টেক্স্ট বই গুলো হোক ছবি আর ব্যখা সমৃদ্ধ। ভূগোল ক্লাশে গ্লোব রাখা হোক। তারা যা জানবে, তা সঠিক ভাবে জানবে। আর যেসব ছাত্র ছাত্রীরা এগিয়ে, তাদের জন্য অতিরিক্ত কিছু অধ্যয়ন থাকুক। যা আমেরিকাতে ম্যাগনেট প্রোগ্রামে করা হয়ে থাকে। এগোনো পেছোনো সব ছাত্র ছাত্রীকে একই সিলেবাস অনুসরন করে চলার চেয়ে, বরং পিছিয়ে থাকদের জন্য ন্যুনতম সিলেবাস আর এগিয়ে থাকাদের জন্য বিস্তৃত সিলেবাস বেশী ফলদায়ক বলে মনে করি। যার ফলে, পিছিয়ে থাকা ছাত্র ছাত্রীরা একটা ন্যুনতম মান অর্জন করে এগোতে পারবে। আর এগিয়ে থাকা ছাত্র ছাত্রীরাও তাদের কাংখিত মানের লক্ষ্যে পৌছুতে পারবে।
শিক্ষা ব্যবস্থা বিভাজনমূলক হলে তার বিষয়ে নীতিমালা অনুসরন করতে হবে। এটা খুব স্বাভাবিক যে, মাদ্রাসায় ধর্ম বিষয়ে বেশী জোর দেয়া হবে, কিন্তু সাধারন শিক্ষায় তা দেয়া হবে না। তা সত্ত্বেও কিছু বিষয়কে সবার জন্য আবশ্যিক করে দেয়া দরকার। সেগুলো হতে পারে, ল্যাংগুয়েজ আর্টস, সাইন্স, ম্যাথ, সোশাল স্টাডিজ। যেমনটি আমেরিকাতে রয়েছে। ল্যাংগুয়েজ আর্টস আবার বিভক্ত হতে পারে কয়েকটি ভাগে: স্পেলিং, গ্রামার, রিডিং, রাইটিং। আমেরিকাতে এর বাইরে ইসলামিক স্কুল গুলো কোরান, এরাবিক, ইসলামিক স্টাডিস পড়িয়ে থাকে। আর সাধারন পাবলিক স্কুলগুলো সম্ভবত আর্টস, স্প্যানিশ -এসব পড়িয়ে থাকে। বিষয়গুলো অপশনাল হওয়ায় শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈচিত্রতা চলে আসে।
বাংলাদেশে দেখলাম ফাইন আর্টসকে বাধ্যতামূলক করা হবে। এ বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। ড্রইং আর মাটির কাজ - এই দুটো সাবজেক্ট আমার প্রাইমারী স্কুলে ছিল। পাশ মার্কস জোগাড় যে কি কঠিন ছিল, তা মনে করলে আজো শিউরে উঠি। এসব ক্লাসে আমাকে কেউ কখনও ধরে ধরে শিখিয়ে দেয় নি। আমার মনে হয় না এসব বিষয় আবশ্যিক হিসেবে থাকা উচিত। যতদিন না ভালভাবে ছাত্র ছাত্রীদের শেখানোর ব্যবস্থা থাকবে, ততদিন সেলাই, মাটির কাজ কিংবা ড্রইং সাবজেক্টগুলো অতিরিক্ত হিসেবে রাখা প্রয়োজন।
মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় মূল ধারার সাবজেক্ট হিসেবে বাংলা, ইংরেজী, সাইন্স, ম্যাথ এবং সোশাল স্টাডিজ আবশ্যিক হিসেবে থাকা প্রয়োজন। সাহিত্য ও সোশাল স্টাডিজ মাদ্রাসা বোর্ডের জন্য আলাদা হতে পারে। জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা উত্তোলন কিংবা শপথ - অন্ততপক্ষে একটিকে মাদ্রাসাগুলোর বেছে নিতে হবে।
সাধারন শিক্ষায়ও ধর্ম ও কোরান শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা উচিত। তবে সাধারন শিক্ষায় আরবী থাকার কোন দরকার নেই। ক্লাস এইট পর্যন্ত আমাদের আরবী পড়তে হয়েছে, অথচ তা থেকে কিছু শিখতে পারিনি। তাই আরবী আমার কাছে অহেতুক মনে হয়। আমেরিকার সাধারন স্কুলে ধর্ম পড়ানো হয় না। বাংলাদেশের সাধারন স্কুলে ধর্ম শিক্ষা স্বাধীনতার পর থেকেই চলে আসছে। এখনো অভিভাবকরা ধর্ম শিক্ষার পক্ষে রয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ গড়তে ধর্ম শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তাহলেই কেউ আর ধর্মের নামে বিভ্রান্ত হবে না।
বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ অত্যন্ত চমৎকার, যা অন্য দেশের জন্য মডেল হতে পারে। এই পরিবেশকে উৎসাহিত করতে সোশাল স্টাডিজে বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন উৎসব যেমন, ঈদ, পুজা, পূর্নিমা সহ বিভিন্ন উৎসবের বর্ননা যোগ করা যেতে পারে, কিন্তু সরাসরি অন্য ধর্মের খুটিনাটি শেখানোটা অপ্রয়োজনীয়।
যাক, অনেক কথা বলে ফেললাম। হয়ত বা অরন্যে রোদন। কিন্তু নিজের কথ গুলো বলার আনন্দ থেকে নিজেকে ফাকি দিতে চাইলাম না।
আমারও কিছু কথা বলতে ইচ্ছা করে। কম্পিউটারের সামনে বসে থাকলে বার বার ইচ্ছে করে ব্লগ সাইটে উকি দিতে। মাঝে মাঝে অন্যের পোস্টে মন্তব্য করি, তবে সবসময় সে অভিজ্ঞতা সুখকর হয় না। মানুষের সাথে মেলামেশায় আমার খুব সুনাম সমাজে নেই, ব্লগেও এটা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুই বছরের উপরে আমার এখানে বিচরন, অথচ শুভাকাংখী ব্লগার বলতে নাহিদ, সোহায়লা, কিংবা পারভেজ ভাই এর মত দুই চারজন হাতে গোনা। আমি তো কোনদিনও কারো আত্ম সম্মানে আঘাত করি না, ডেল কার্নেগীর বন্ধু বিষয়ক বই অনাগ্রহ, বিতৃষ্ণা নিয়ে পড়ি শুধুমাত্র বন্ধুবৎসল হবার জন্যে, কিন্তু তবুও আজতক বন্ধুহীন হয়েই রইলাম। যার নয়ে হয় না, নব্বইতেও সে না হবার দলেই থাকে।
শিক্ষা নীতি নিয়ে কথা বলতে এসে নিজের প্রসংগে এত গুলো কথার অবতারনার কারন একটিই। আমি বাংলাদেশের প্রস্তাবিত শিক্ষা নীতি নিয়ে খুব বেশী কিছু জানি না, অথচ এ নিয়ে পোস্ট দিতে চাই। প্রেম ভালোবাসা টাইপ পোস্ট দেবার ক্ষমতা আমার নেই, তার জন্য রোমান্টিক মননশীলতার দরকার, যা আমার কোন কালেই ছিল না। কিন্তু শিক্ষানীতির বিষয়ে জ্ঞান না থাকলেও, শিক্ষার বিষয়ে আগ্রহটুকু আছে। যার ফলে পোস্টে হয়ত এ বিষয়ে নিজের এলোমেলো ভাবনাগুলো তুলে ধরা আমার পক্ষে অসম্ভব হবে না।
প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি নিয়ে কথা বলতে আমার আগ্রহের কারন আমার নিজের শৈশব বেলার অভিজ্ঞতা। জীবনের মেটামরফোসিস বিশ্লেষন করলে দেখা যায় মানুষের সবচেয়ে ভাবনাহীন আলোকিত সময়টি হচ্ছে তার শৈশব - যে সময়টা মানুষ থাকে সবচেয়ে বেশী স্বাধীন এবং উৎফুল্ল। সে সময়টাতে তাকে শেখাতে হয় আনন্দের সাথে। একবার যদি শেখার আনন্দ থেকে বিচ্যুত হয়ে সে নিরানন্দতার সাথে জুটি বাধে, তবে সে শিক্ষার সাথে পরবর্তীতে একাত্ম হওয়া তার পক্ষে কঠিন।
প্রথমেই বলে রাখছি, আমি বিভাজনমূলক শিক্ষার সমর্থক। আমেরিকার এই বিভাজন মূলক শিক্ষা ব্যবস্থার যে ভাল দিকটি আমার কাছে ফুটে উঠেছে তা হল, এর ফলে শিশুদের শিক্ষিত হবার সুব্যবস্থা অনেক বেশী থাকে। উদাহরন স্বরূপ বলা চলে, এদের একটি স্বীকৃত শিক্ষা ব্যবস্থা হল হোম স্কুলিং। অনেক পিতামাতা পাবলিক স্কুলে সন্তানদের দিতে চান না, কিংবা দেবার অবস্থায় থাকেন না। তারা স্বচ্ছন্দে নিজেদের সন্তানদের হোম স্কুলিং করিয়ে থাকেন। পাবলিক স্কুল ফ্রী, তবে ডিসিপ্লিনের জন্য অনেকে প্রাইভেট স্কুলে অনেক টিউশন দিয়ে বাচ্চাদের পড়িয়ে থাকেন। ক্যাথলিক স্কুল কিংবা অন্যান্য ধর্মীয় স্কুল গুলোও সগৌরবে টিকে আছে তাদের পরিবেশ ও ডিসিপ্লিনের কারনে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে বিষয়টি আমার কাছে উদ্বেগজনক মনে হয়েছে, তা হল পাশের হার। এখনও পাশের হার শতকরা ৫০ ভাগের বেশী নয়। তার মানে অর্ধেকেরও বেশী ছাত্র ছাত্রী তাদের কাংখিত লক্ষ্যে পৌছুতে সক্ষম নয়।
এই বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা নীতিতে জোর দেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। এই ৫০ ভাগ ছাত্র ছাত্রী কি জন্য পিছিয়ে আছে। এদেরকে কি করে সামনে এগিয়ে আনা যায়? এরা কি কারনে শিক্ষা কারিকুলামের মূল সুরটি ধরতে ব্যর্থ? পাশ্চাত্যের উদাহরন টানা যাক। পাশ্চাত্যে শিক্ষার মান মোটামুটি উন্নত। কোন সাবজেক্টে কোন ছাত্র ছাত্রী পিছিয়ে থাকলে, স্কুল থেকে তার জন্য আলাদা টিউটরিং এর ব্যবস্থা রাখা হয়। এছাড়া তাদের টেক্সট বইগুলো সহজ ভাষায় লেখা, ছবি সমৃদ্ধ এবং সিলেবাস খুব একটা বিস্তৃত নয়। যার ফলে ছাত্র ছাত্রীদের পক্ষে একটা ন্যুনতম মান অর্জন করা খুব কঠিন হয় না। বাংলাদেশে কেন তবে তা এত কঠিন? তার কারন, শিক্ষক ছাত্রের উচু অনুপাতের ফলে ছাত্রের জন্য একজন শিক্ষকের প্রয়োজনীয় সময় প্রদানে অক্ষমতা, সিলেবাসের ব্যপকতা, টেক্স্ট বইগুলো দুর্বোধ্য ভাষা এবং সবশেষে একটি বিষয়কে সহজ ভাবে উপস্থাপনায় শিক্ষকের ব্যর্থতা। মূলত এই কারন গুলোই ছাত্র/ছাত্রীদের ব্যর্থতার জন্য দায়ী। ছাত্র ছাত্রীদের কাছে শিক্ষাকে সহজবোধ্য আর আনন্দময় করে তোলা যে কোন শিক্ষা নীতিতে সবচেয়ে বেশী অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। যার অবধারিত কনসিকুয়েন্স হচ্ছে পাশের হার বেড়ে যাওয়া। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখেছি শিক্ষা নীতি যখন আলোচিত হয়, তখন এই বিষয়টিকে খুব একটা জোর দিতে দেখা যায় না। ধরে নেয়া হয়, ফাকিবাজ হলে তার পক্ষে অকৃতকার্য হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু ফাকিবাজ হবার ছিদ্র গুলো বন্ধ করতে চাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। আমাদের ছেলেমেয়েদের সবাইকে কেন এত এত বেশী বই পড়তে হবে, আর এত বেশী জানতে হবে? দিন না, জেনারেল সিলেবাস একটু কমিয়ে। টেক্স্ট বই গুলো হোক ছবি আর ব্যখা সমৃদ্ধ। ভূগোল ক্লাশে গ্লোব রাখা হোক। তারা যা জানবে, তা সঠিক ভাবে জানবে। আর যেসব ছাত্র ছাত্রীরা এগিয়ে, তাদের জন্য অতিরিক্ত কিছু অধ্যয়ন থাকুক। যা আমেরিকাতে ম্যাগনেট প্রোগ্রামে করা হয়ে থাকে। এগোনো পেছোনো সব ছাত্র ছাত্রীকে একই সিলেবাস অনুসরন করে চলার চেয়ে, বরং পিছিয়ে থাকদের জন্য ন্যুনতম সিলেবাস আর এগিয়ে থাকাদের জন্য বিস্তৃত সিলেবাস বেশী ফলদায়ক বলে মনে করি। যার ফলে, পিছিয়ে থাকা ছাত্র ছাত্রীরা একটা ন্যুনতম মান অর্জন করে এগোতে পারবে। আর এগিয়ে থাকা ছাত্র ছাত্রীরাও তাদের কাংখিত মানের লক্ষ্যে পৌছুতে পারবে।
শিক্ষা ব্যবস্থা বিভাজনমূলক হলে তার বিষয়ে নীতিমালা অনুসরন করতে হবে। এটা খুব স্বাভাবিক যে, মাদ্রাসায় ধর্ম বিষয়ে বেশী জোর দেয়া হবে, কিন্তু সাধারন শিক্ষায় তা দেয়া হবে না। তা সত্ত্বেও কিছু বিষয়কে সবার জন্য আবশ্যিক করে দেয়া দরকার। সেগুলো হতে পারে, ল্যাংগুয়েজ আর্টস, সাইন্স, ম্যাথ, সোশাল স্টাডিজ। যেমনটি আমেরিকাতে রয়েছে। ল্যাংগুয়েজ আর্টস আবার বিভক্ত হতে পারে কয়েকটি ভাগে: স্পেলিং, গ্রামার, রিডিং, রাইটিং। আমেরিকাতে এর বাইরে ইসলামিক স্কুল গুলো কোরান, এরাবিক, ইসলামিক স্টাডিস পড়িয়ে থাকে। আর সাধারন পাবলিক স্কুলগুলো সম্ভবত আর্টস, স্প্যানিশ -এসব পড়িয়ে থাকে। বিষয়গুলো অপশনাল হওয়ায় শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈচিত্রতা চলে আসে।
বাংলাদেশে দেখলাম ফাইন আর্টসকে বাধ্যতামূলক করা হবে। এ বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। ড্রইং আর মাটির কাজ - এই দুটো সাবজেক্ট আমার প্রাইমারী স্কুলে ছিল। পাশ মার্কস জোগাড় যে কি কঠিন ছিল, তা মনে করলে আজো শিউরে উঠি। এসব ক্লাসে আমাকে কেউ কখনও ধরে ধরে শিখিয়ে দেয় নি। আমার মনে হয় না এসব বিষয় আবশ্যিক হিসেবে থাকা উচিত। যতদিন না ভালভাবে ছাত্র ছাত্রীদের শেখানোর ব্যবস্থা থাকবে, ততদিন সেলাই, মাটির কাজ কিংবা ড্রইং সাবজেক্টগুলো অতিরিক্ত হিসেবে রাখা প্রয়োজন।
মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় মূল ধারার সাবজেক্ট হিসেবে বাংলা, ইংরেজী, সাইন্স, ম্যাথ এবং সোশাল স্টাডিজ আবশ্যিক হিসেবে থাকা প্রয়োজন। সাহিত্য ও সোশাল স্টাডিজ মাদ্রাসা বোর্ডের জন্য আলাদা হতে পারে। জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা উত্তোলন কিংবা শপথ - অন্ততপক্ষে একটিকে মাদ্রাসাগুলোর বেছে নিতে হবে।
সাধারন শিক্ষায়ও ধর্ম ও কোরান শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা উচিত। তবে সাধারন শিক্ষায় আরবী থাকার কোন দরকার নেই। ক্লাস এইট পর্যন্ত আমাদের আরবী পড়তে হয়েছে, অথচ তা থেকে কিছু শিখতে পারিনি। তাই আরবী আমার কাছে অহেতুক মনে হয়। আমেরিকার সাধারন স্কুলে ধর্ম পড়ানো হয় না। বাংলাদেশের সাধারন স্কুলে ধর্ম শিক্ষা স্বাধীনতার পর থেকেই চলে আসছে। এখনো অভিভাবকরা ধর্ম শিক্ষার পক্ষে রয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ গড়তে ধর্ম শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তাহলেই কেউ আর ধর্মের নামে বিভ্রান্ত হবে না।
বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ অত্যন্ত চমৎকার, যা অন্য দেশের জন্য মডেল হতে পারে। এই পরিবেশকে উৎসাহিত করতে সোশাল স্টাডিজে বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন উৎসব যেমন, ঈদ, পুজা, পূর্নিমা সহ বিভিন্ন উৎসবের বর্ননা যোগ করা যেতে পারে, কিন্তু সরাসরি অন্য ধর্মের খুটিনাটি শেখানোটা অপ্রয়োজনীয়।
যাক, অনেক কথা বলে ফেললাম। হয়ত বা অরন্যে রোদন। কিন্তু নিজের কথ গুলো বলার আনন্দ থেকে নিজেকে ফাকি দিতে চাইলাম না।
blog rating/ban
ISSUES ABOUT BLOG BAN:
বাংলা ব্লগ এখনও তার শৈশব কাটায় নি। আমাদের ব্লগারদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। তিন বছর আগের সেই ব্লগিং প্ল্যাটফর্ম এবং আজকের ব্লগিং প্লাটফর্মের মধ্যে রয়েছে আকাশ পাতাল দূরত্ব। এবং সেটাই নির্দেশ করছে বাংলা ব্লগিং এর সাফল্য।
বাংলা ব্লগকে সাধারন বাংগালীর কাছে জনপ্রিয় করতে যে প্রতিষ্ঠানকে স্বীকৃতি দিতেই হয়, তা হল সামহোয়ার ইন। ব্লগিং প্লাটফর্মের সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে ধীরে ধীরে জয় করে সামহোয়ার এখন মোটামুটি স্থায়ীত্ব লাভ করেছে। এছাড়াও প্রথম আলো ব্লগ ও আমার ব্লগও মোটামুটি মানের জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে ব্লগ জগতকে একটি বিকল্প মিডিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে আরো বহু সময় দিতে হবে। কিছুদিন আগে আমি আমার একটি লেখায় ব্লগের এই প্রাথমিক সাফল্যকে স্বীকৃতি জানিয়ে লিখেছিলাম:
"তবে আশার কথা এই যে প্লাটফর্মের সংখ্যা বাড়ছে। চাইলেও কারো কন্ঠরোধ করা আর সম্ভবপর হবে না। ইন্টারনেট এক বিশাল সমুদ্র। সেখানে "যে লড়ে সে টেকে" বা "survival of the fittest" মতবাদের সার্থক রূপ প্রতিফলিত হয়। আর এই "লড়া"টা হতে হবে বুদ্ধিভিত্তিক, নোংরামি ভিত্তিক নয়। প্লাটফর্মের সংখ্যা বেড়ে গেল আপনা আপনিই বুদ্ধি ভিত্তিক প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরী হবে, নোংরামী দিয়ে তা বন্ধ করা যাবে না।"
ব্লগিং এর একটি চ্যালেন্জ্ঞ হচ্ছে ব্যান। ব্লগ একটি হালকা মেজাজের প্লাটফর্ম বিধায় এখানে অনেক সময় অনেকেই অনেক কথাবার্তা লিখে থাকেন। যার ফলে শুধু অস্থির মেজাজের নয়, বরং অনেক ভাল ভাল ব্লগারদের উপরেও ব্যানের তলোয়ার নেমে এসেছে। ব্লগের মূল প্রান হল তার ব্লগাররা। ডিসিপ্লিনারী একশনের তোড়ে যদি ব্লগাররাই ব্লগিং এর পরিবেশ না পায়, তাহলে ব্লগ আর জেলখানার মধ্যে কোন তফাৎ থাকে না। ব্লগিং এর ডিসিপ্লিনারী একশন হিসেবে ব্যান তাই খুব পছন্দনীয় কোন ডিসিপ্লিনারী একশন নয়। তা সত্ত্বেও "ব্যান" এখনও ব্লগিং প্লাটফর্মগুলোর মূল ডিসিপ্লিনারী একশন। কিছু দিন আগে প্রথম আলো ব্লগে ম্যাভেরিক ভাই ব্যান পরবর্তী উল্লাস জাতীয় কথাবার্তা নিরুৎসাহিত করতে অনুরোধ জানিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। কথা হচ্ছে, যাকে ব্যান করা হয়েছে সে কোন ভাবেই আর আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারছে না। যে ব্যান হয়, সে অনেকের কাছে অপ্রিয়, তবে কারো কারো কাছে সে প্রিয়। তাই, এ জাতীয় উল্লাস সূচক কথাবার্তা স্বভাবতই অনেককে আহত করে থাকে। সুতরাং এ বিষয়টির দিকে ব্লগ কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া জরূরী।
দ্বিতীয় ইস্যুটি হল "স্থায়ী ব্যান" কিংবা "লগ ইন" ব্যান। ক্রমাগত ব্লগ রুল ভংগ করা, কিংবা নিশ্চিত ভাবে ব্লগ পরিবেশকে বার বার উস্কানীর চেষ্টা ব্যতীরেকে কারো উপর এ ধরনের চূড়ান্ত শাস্তি না প্রয়োগ করাই ভাল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও দেখা গেছে, যাদের বিরুদ্ধে সেরকম কোন অভিযোগ নেই, তাদের বিরুদ্ধেও এরকম শাস্তির খাড়া নেমে এসেছে। এই বিষয়টির নিয়েও কর্তৃপক্ষ নজর দেবেন আশা করি। এটি একজন "ভিকটিম" ব্লগার শুধু নয়, বরং পুরো ব্লগ কমিউনিটিকে এক ধরনের অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়। ব্লগ রুল ভংগ করা যে ব্লগারের স্বভাব কৌশল নয়, তার ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে "চূড়ান্ত ব্যান" কাম্য নয়। প্রতিপক্ষ ব্লগাররা হয়ত এতে সাময়িক আনন্দ লাভ করতে পারে, তবে এর প্রতিক্রিয়া সুদূর প্রসারী। যার ফলশ্রূতিতে ব্লগিং প্লাটফর্মগুলো এখনও তাদের পুরোনো ব্লগারদের ধরে রাখতে ব্যর্থ। এই ব্যর্থতা ব্লগিং প্লাটফর্মের ব্যর্থতা, যার মুখোমুখি হওয়া জরূরী।
শেষ কথা হল, ব্লগারের লেখার ক্ষমতা, তার ব্লগ বয়স - এগুলোও ব্যানের ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। তিন বছরের পুরোনো ব্লগার যে ইতিমধ্যেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, আর তিন দিনের ব্লগার যে এখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নি -ব্লগ নীতিমালা দুজনের ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রযুক্ত হওয়া অন্তত আমি সমর্থন করতে পারছি না। পুরোনো ব্লগারদের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা কাম্য। তেমনি ভাবে, যেসব ব্লগারের লেখা সার্বিকভাবে সবার গ্রহনযোগ্যতা পায়, তাদের ক্ষেত্রেও কিছুটা শিথিলতা দেয়া হোক।
(আমার এই লেখাটি সামহোয়ারে সদ্য ব্যান হওয়া নাহিদকে উৎসর্গ করে। তার ব্যানই আমাকে এ লেখাটি লিখতে উৎসাহী করেছে। তার আনব্যানের বিষয়টি সম্পূর্নভাবে কর্তৃপক্ষের বিবেচনার বিষয়, তবে তাকে "আনব্যান" দেখলে আমি খুশী হই।)
হ্যাপি ব্লগিং।
ISSUES ABOUT BLOG RATING:
সামহোয়ার ব্লগে মাইনাস রেটিং এর জন্য নূতন নিয়ম হয়েছে। কেউ ব্লকড হলে সে আর ব্লককারী ব্লগারের পোস্টে মাইনাস রেটিং করতে পারবে না।
আমি এই নিয়ম টেস্ট করতে গিয়ে একজনের ব্লগের একটি পোস্টে মাইনাস দিলাম (যার ব্লগে আমি ব্লকড বলে জানতাম)। অপেক্ষা করছি কি হয় সেটা দেখার জন্য। দেখি মাইনাস রেটিং কাজ করল। বিষয় কি? উল্টো হলো কেন? দেখলাম তার ব্লগে আমি আর এখন ব্লকড নেই - আনব্লক হয়ে গেছি। ধূর ছাই, অহেতুক মাইনাসটা পড়ল। যাহোক, আরেকজনের ব্লগে গিয়ে অবশ্য নিয়মটা ভেরিফাই করে আসলাম। তার ব্লগে এখনও আমি ব্লকড বলে মাইনাসের নিয়মটা টেস্ট করা গেল।
ব্লগার ফকির ইলিয়াস বলেছেন মাইনাসের এই নিয়মটির প্রস্তাব তিনি করেছিলান।
Click This Link
ফকির ইলিয়াসের জন্য যদি মাইনাসের এই নিয়ম চালু হয়ে থাকে তবে সেটা খুব একটা বড় অন্যায় নয়। কারন উনার এমন অনেক লেখায় মাইনাসের পাহাড় পড়ে যে সেটা খুব জঘন্য লাগে, নিজের কাছেই বিব্রত লাগে।
তবে এই নিয়মটির প্রস এন্ড কনস দুটো দিকই আছে।
প্রথমেই বলে রাখি আমি একজন মাইনাস খাওয়া ব্লগার। আমার পোস্টে মাইনাসের আধিক্য। কিন্তু সেটা আমি কি করে যেন ইগনোর করতে পেরেছি। আমার একটি পোস্টে আমি বিডিআর বিদ্রোহে সরকারের ঢালাও সাধারন ক্ষমার বিরোধিতা করেছিলাম। ব্যপক মাইনাস পড়ে সে পোস্টে। পরে দেখা গেল সরকার নিজেই পিছু হঠেছে সাধারন ক্ষমা থেকে। আবেগ দিয়ে যে দেশ চালানো যায় না, সেটা সরকার দেরীতে হলেও বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু আমি তখন ঠিক একই কথা বলায় আম ব্লগাররা তা পছন্দ করে নি। গনহারে মাইনাস সহ্য করতে হয়।
সামহোয়ারে মাইনাসের ব্যপক অপপ্রয়োগের অন্যতম সফল একটি দৃষ্টান্ত হল মাহবুব মোর্শেদের উপর কিছু ব্লগারদের প্রতিশোধ নেয়া। এই মাইনাস অস্ত্র উনার উপর সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়। উনি কাবু হন এই অস্ত্রে।
নূতন নিয়মে এসব পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি দেখা যাবে সম্ভবত। ভুয়া নিকের অধিকারী হয়ে যাকে অপছন্দ করি তাকে মাইনাসের আধিক্য দিয়ে অপদস্ত করতে চাওয়ার চলে আসা বিষয়টা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রিত হবে।
কিন্তু অপর পিঠও তো রয়েছে।
মাইনাস কি লেখককে কিছুই দেয় নি।
পোস্ট ভাল কি মন্দ তা বোঝা যায় মাইনাস রেটিং দিয়ে।
মানুষের সেন্টিমেন্ট কোনদিকে সেটা বোঝার একটি দিক নিদের্শনা হল মাইনাস/প্লাস রেটিং।
সাধারনের মাঝে ব্লগারের গ্রহনযোগ্যতা কতটুকু সেটাও বোঝা যায় মাইনাস থেকে। অতিশয় খারাপ পোস্টও কোন প্রিয় ব্লগারের কাছ থেকে এলে আমরা মাইনাস দিতে কষ্ট পাই। আর অপ্রিয় ব্লগারের পোস্টে ছুতো খুজি মাইনাস দেবার।
এই তিনটি কারনের দ্বারাই একজন ব্লগার মাইনাস রেটিং পেয়ে থাকে। তাই মাইনাস একটি বড় শক্তিশালী ইনফরমেশন।
যেমন, আমার ব্লগে ইদানিং মাইনাস খুব বেশী আর দেখছি না। এর মানে ধরে নিচ্ছি, মানুষ এখন আর আমাকে ততটা অবিশ্বাস করছে না। আস্তে আস্তে আমার উপর মানুষের বিরক্তি কমে আসছে।
অথচ এই ইনফরমেশনটা সামনে থেকে জানতে হলে আমাকে এখন সবাইকে আনব্লক করতে হবে। কিন্তু গালিবাজ, আর ফ্লাডিং এর রিস্ক তাতে পুরোপুরি থেকে যায়।
সবশেষে:
ফকির ইলিয়াস তার পোস্টে বলেছেন:
"আমার বিশ্বাস প্রকৃত লেখক-লেখিকারা এই সংযোজনে মুক্তির নিঃশ্বাস
নিচ্ছেন।"
আমার কিন্তু বরং মনে হচ্ছে আমি অনেক কিছু হারালাম (উল্লেখ্য আমি নিজেকে প্রকৃত লেখিকার কাতারে ফেলে থাকি)। আগে মাইনাসের জন্য হলেও গালিবাজ ব্লগাররা (যাদের ব্লক করে রেখেছি) আমার পোস্ট পড়ত। এখন সে দায়টা তাদের আর নেই।
নিঃশ্বাস ফেললাম, তবে তা আক্ষেপের।
বি: দ্র: এই পোস্টটি লেখার পর বুঝলাম নিয়মটি শুধু মাইনাস নয়, বরং প্লাসের জন্যও প্রযোজ্য। ব্লগের কিছু পোস্ট পড়ে আমার মনে হয়েছিল, এটা বুঝি শুধু মাইনাসের জন্য প্রযোজ্য।
স্যরি ফর দ্য মিসটেক।
বাংলা ব্লগ এখনও তার শৈশব কাটায় নি। আমাদের ব্লগারদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। তিন বছর আগের সেই ব্লগিং প্ল্যাটফর্ম এবং আজকের ব্লগিং প্লাটফর্মের মধ্যে রয়েছে আকাশ পাতাল দূরত্ব। এবং সেটাই নির্দেশ করছে বাংলা ব্লগিং এর সাফল্য।
বাংলা ব্লগকে সাধারন বাংগালীর কাছে জনপ্রিয় করতে যে প্রতিষ্ঠানকে স্বীকৃতি দিতেই হয়, তা হল সামহোয়ার ইন। ব্লগিং প্লাটফর্মের সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে ধীরে ধীরে জয় করে সামহোয়ার এখন মোটামুটি স্থায়ীত্ব লাভ করেছে। এছাড়াও প্রথম আলো ব্লগ ও আমার ব্লগও মোটামুটি মানের জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে ব্লগ জগতকে একটি বিকল্প মিডিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে আরো বহু সময় দিতে হবে। কিছুদিন আগে আমি আমার একটি লেখায় ব্লগের এই প্রাথমিক সাফল্যকে স্বীকৃতি জানিয়ে লিখেছিলাম:
"তবে আশার কথা এই যে প্লাটফর্মের সংখ্যা বাড়ছে। চাইলেও কারো কন্ঠরোধ করা আর সম্ভবপর হবে না। ইন্টারনেট এক বিশাল সমুদ্র। সেখানে "যে লড়ে সে টেকে" বা "survival of the fittest" মতবাদের সার্থক রূপ প্রতিফলিত হয়। আর এই "লড়া"টা হতে হবে বুদ্ধিভিত্তিক, নোংরামি ভিত্তিক নয়। প্লাটফর্মের সংখ্যা বেড়ে গেল আপনা আপনিই বুদ্ধি ভিত্তিক প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরী হবে, নোংরামী দিয়ে তা বন্ধ করা যাবে না।"
ব্লগিং এর একটি চ্যালেন্জ্ঞ হচ্ছে ব্যান। ব্লগ একটি হালকা মেজাজের প্লাটফর্ম বিধায় এখানে অনেক সময় অনেকেই অনেক কথাবার্তা লিখে থাকেন। যার ফলে শুধু অস্থির মেজাজের নয়, বরং অনেক ভাল ভাল ব্লগারদের উপরেও ব্যানের তলোয়ার নেমে এসেছে। ব্লগের মূল প্রান হল তার ব্লগাররা। ডিসিপ্লিনারী একশনের তোড়ে যদি ব্লগাররাই ব্লগিং এর পরিবেশ না পায়, তাহলে ব্লগ আর জেলখানার মধ্যে কোন তফাৎ থাকে না। ব্লগিং এর ডিসিপ্লিনারী একশন হিসেবে ব্যান তাই খুব পছন্দনীয় কোন ডিসিপ্লিনারী একশন নয়। তা সত্ত্বেও "ব্যান" এখনও ব্লগিং প্লাটফর্মগুলোর মূল ডিসিপ্লিনারী একশন। কিছু দিন আগে প্রথম আলো ব্লগে ম্যাভেরিক ভাই ব্যান পরবর্তী উল্লাস জাতীয় কথাবার্তা নিরুৎসাহিত করতে অনুরোধ জানিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। কথা হচ্ছে, যাকে ব্যান করা হয়েছে সে কোন ভাবেই আর আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারছে না। যে ব্যান হয়, সে অনেকের কাছে অপ্রিয়, তবে কারো কারো কাছে সে প্রিয়। তাই, এ জাতীয় উল্লাস সূচক কথাবার্তা স্বভাবতই অনেককে আহত করে থাকে। সুতরাং এ বিষয়টির দিকে ব্লগ কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া জরূরী।
দ্বিতীয় ইস্যুটি হল "স্থায়ী ব্যান" কিংবা "লগ ইন" ব্যান। ক্রমাগত ব্লগ রুল ভংগ করা, কিংবা নিশ্চিত ভাবে ব্লগ পরিবেশকে বার বার উস্কানীর চেষ্টা ব্যতীরেকে কারো উপর এ ধরনের চূড়ান্ত শাস্তি না প্রয়োগ করাই ভাল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও দেখা গেছে, যাদের বিরুদ্ধে সেরকম কোন অভিযোগ নেই, তাদের বিরুদ্ধেও এরকম শাস্তির খাড়া নেমে এসেছে। এই বিষয়টির নিয়েও কর্তৃপক্ষ নজর দেবেন আশা করি। এটি একজন "ভিকটিম" ব্লগার শুধু নয়, বরং পুরো ব্লগ কমিউনিটিকে এক ধরনের অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়। ব্লগ রুল ভংগ করা যে ব্লগারের স্বভাব কৌশল নয়, তার ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে "চূড়ান্ত ব্যান" কাম্য নয়। প্রতিপক্ষ ব্লগাররা হয়ত এতে সাময়িক আনন্দ লাভ করতে পারে, তবে এর প্রতিক্রিয়া সুদূর প্রসারী। যার ফলশ্রূতিতে ব্লগিং প্লাটফর্মগুলো এখনও তাদের পুরোনো ব্লগারদের ধরে রাখতে ব্যর্থ। এই ব্যর্থতা ব্লগিং প্লাটফর্মের ব্যর্থতা, যার মুখোমুখি হওয়া জরূরী।
শেষ কথা হল, ব্লগারের লেখার ক্ষমতা, তার ব্লগ বয়স - এগুলোও ব্যানের ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। তিন বছরের পুরোনো ব্লগার যে ইতিমধ্যেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, আর তিন দিনের ব্লগার যে এখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নি -ব্লগ নীতিমালা দুজনের ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রযুক্ত হওয়া অন্তত আমি সমর্থন করতে পারছি না। পুরোনো ব্লগারদের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা কাম্য। তেমনি ভাবে, যেসব ব্লগারের লেখা সার্বিকভাবে সবার গ্রহনযোগ্যতা পায়, তাদের ক্ষেত্রেও কিছুটা শিথিলতা দেয়া হোক।
(আমার এই লেখাটি সামহোয়ারে সদ্য ব্যান হওয়া নাহিদকে উৎসর্গ করে। তার ব্যানই আমাকে এ লেখাটি লিখতে উৎসাহী করেছে। তার আনব্যানের বিষয়টি সম্পূর্নভাবে কর্তৃপক্ষের বিবেচনার বিষয়, তবে তাকে "আনব্যান" দেখলে আমি খুশী হই।)
হ্যাপি ব্লগিং।
ISSUES ABOUT BLOG RATING:
সামহোয়ার ব্লগে মাইনাস রেটিং এর জন্য নূতন নিয়ম হয়েছে। কেউ ব্লকড হলে সে আর ব্লককারী ব্লগারের পোস্টে মাইনাস রেটিং করতে পারবে না।
আমি এই নিয়ম টেস্ট করতে গিয়ে একজনের ব্লগের একটি পোস্টে মাইনাস দিলাম (যার ব্লগে আমি ব্লকড বলে জানতাম)। অপেক্ষা করছি কি হয় সেটা দেখার জন্য। দেখি মাইনাস রেটিং কাজ করল। বিষয় কি? উল্টো হলো কেন? দেখলাম তার ব্লগে আমি আর এখন ব্লকড নেই - আনব্লক হয়ে গেছি। ধূর ছাই, অহেতুক মাইনাসটা পড়ল। যাহোক, আরেকজনের ব্লগে গিয়ে অবশ্য নিয়মটা ভেরিফাই করে আসলাম। তার ব্লগে এখনও আমি ব্লকড বলে মাইনাসের নিয়মটা টেস্ট করা গেল।
ব্লগার ফকির ইলিয়াস বলেছেন মাইনাসের এই নিয়মটির প্রস্তাব তিনি করেছিলান।
Click This Link
ফকির ইলিয়াসের জন্য যদি মাইনাসের এই নিয়ম চালু হয়ে থাকে তবে সেটা খুব একটা বড় অন্যায় নয়। কারন উনার এমন অনেক লেখায় মাইনাসের পাহাড় পড়ে যে সেটা খুব জঘন্য লাগে, নিজের কাছেই বিব্রত লাগে।
তবে এই নিয়মটির প্রস এন্ড কনস দুটো দিকই আছে।
প্রথমেই বলে রাখি আমি একজন মাইনাস খাওয়া ব্লগার। আমার পোস্টে মাইনাসের আধিক্য। কিন্তু সেটা আমি কি করে যেন ইগনোর করতে পেরেছি। আমার একটি পোস্টে আমি বিডিআর বিদ্রোহে সরকারের ঢালাও সাধারন ক্ষমার বিরোধিতা করেছিলাম। ব্যপক মাইনাস পড়ে সে পোস্টে। পরে দেখা গেল সরকার নিজেই পিছু হঠেছে সাধারন ক্ষমা থেকে। আবেগ দিয়ে যে দেশ চালানো যায় না, সেটা সরকার দেরীতে হলেও বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু আমি তখন ঠিক একই কথা বলায় আম ব্লগাররা তা পছন্দ করে নি। গনহারে মাইনাস সহ্য করতে হয়।
সামহোয়ারে মাইনাসের ব্যপক অপপ্রয়োগের অন্যতম সফল একটি দৃষ্টান্ত হল মাহবুব মোর্শেদের উপর কিছু ব্লগারদের প্রতিশোধ নেয়া। এই মাইনাস অস্ত্র উনার উপর সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়। উনি কাবু হন এই অস্ত্রে।
নূতন নিয়মে এসব পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি দেখা যাবে সম্ভবত। ভুয়া নিকের অধিকারী হয়ে যাকে অপছন্দ করি তাকে মাইনাসের আধিক্য দিয়ে অপদস্ত করতে চাওয়ার চলে আসা বিষয়টা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রিত হবে।
কিন্তু অপর পিঠও তো রয়েছে।
মাইনাস কি লেখককে কিছুই দেয় নি।
পোস্ট ভাল কি মন্দ তা বোঝা যায় মাইনাস রেটিং দিয়ে।
মানুষের সেন্টিমেন্ট কোনদিকে সেটা বোঝার একটি দিক নিদের্শনা হল মাইনাস/প্লাস রেটিং।
সাধারনের মাঝে ব্লগারের গ্রহনযোগ্যতা কতটুকু সেটাও বোঝা যায় মাইনাস থেকে। অতিশয় খারাপ পোস্টও কোন প্রিয় ব্লগারের কাছ থেকে এলে আমরা মাইনাস দিতে কষ্ট পাই। আর অপ্রিয় ব্লগারের পোস্টে ছুতো খুজি মাইনাস দেবার।
এই তিনটি কারনের দ্বারাই একজন ব্লগার মাইনাস রেটিং পেয়ে থাকে। তাই মাইনাস একটি বড় শক্তিশালী ইনফরমেশন।
যেমন, আমার ব্লগে ইদানিং মাইনাস খুব বেশী আর দেখছি না। এর মানে ধরে নিচ্ছি, মানুষ এখন আর আমাকে ততটা অবিশ্বাস করছে না। আস্তে আস্তে আমার উপর মানুষের বিরক্তি কমে আসছে।
অথচ এই ইনফরমেশনটা সামনে থেকে জানতে হলে আমাকে এখন সবাইকে আনব্লক করতে হবে। কিন্তু গালিবাজ, আর ফ্লাডিং এর রিস্ক তাতে পুরোপুরি থেকে যায়।
সবশেষে:
ফকির ইলিয়াস তার পোস্টে বলেছেন:
"আমার বিশ্বাস প্রকৃত লেখক-লেখিকারা এই সংযোজনে মুক্তির নিঃশ্বাস
নিচ্ছেন।"
আমার কিন্তু বরং মনে হচ্ছে আমি অনেক কিছু হারালাম (উল্লেখ্য আমি নিজেকে প্রকৃত লেখিকার কাতারে ফেলে থাকি)। আগে মাইনাসের জন্য হলেও গালিবাজ ব্লগাররা (যাদের ব্লক করে রেখেছি) আমার পোস্ট পড়ত। এখন সে দায়টা তাদের আর নেই।
নিঃশ্বাস ফেললাম, তবে তা আক্ষেপের।
বি: দ্র: এই পোস্টটি লেখার পর বুঝলাম নিয়মটি শুধু মাইনাস নয়, বরং প্লাসের জন্যও প্রযোজ্য। ব্লগের কিছু পোস্ট পড়ে আমার মনে হয়েছিল, এটা বুঝি শুধু মাইনাসের জন্য প্রযোজ্য।
স্যরি ফর দ্য মিসটেক।
Friday, October 9, 2009
১২ই অক্টোবর: কলম্বাস ডে, যেভাবে আমেরিকা আবিষ্কৃত হল
১২ই অক্টোবর: কলম্বাস ডে, যেভাবে আমেরিকা আবিষ্কৃত হল
০৩ রা অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১:০৩
১৪৯২ সাল। সময়টা ক্যাথলিকদের জন্য অত্যন্ত শুভ। গ্রানাডা বিজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা তারা তখন স্পেনে। রানী ইসাবেলা এবং রাজা ফার্ডিনান্ডের নেতৃত্বে ক্যাথলিকরা অবশেষে পরাভূত করতে পেরেছে মুসলিমদের। মুসলিমদের যে অযোগ্য নেতৃত্ব গ্রানাডাতে টিম টিম করে জ্বলছিল, তা সম্পূর্ন নির্বাপিত হয়ে স্পেনে আলোকিত হয়েছে ক্যাথলিকদের বিজয় মশাল।
এই শুভ ক্ষনে একজন ক্যাথলিক নাবিক কলম্বাস দেখা করতে চাইলেন রানী ইসাবেলার সাথে। রানীর সাথে কয়েক বছর আগেও তিনি দেখা করেছিলেন। কিন্তু সেবার রানীকে রাজী করাতে পারেন নি। কিন্তু এখনকার কথা তো আলাদা। এখন তো আমরা বিজয়ী। এখন নিশ্চয়ই রানী রাজী হবেন।
রানী সত্যিই রাজী হলেন কলম্বাসের কথায়। কলম্বাস তাকে আশা দিলেন পশ্চিমের নূতন গতিপথ দিয়ে ভারত আবিষ্কার করতে পারলে প্রচুর সম্পদ পৌছে যাবে রানীর কাছে। পশ্চিমের এ পথ হবে পূবের জ্ঞাত পথের চেয়ে সহজতর। এতে করে ক্যাথলিজম আরো কয়েক গুন বেশী প্রসারিত হবে। রানী যেন এ যাত্রায় সম্মতি দেন। তার যাত্রা পথের খরচ বহন করেন। রানীর পৃষ্ঠপোষকতার যে বড়ই প্রয়োজন।
রানী রাজি হলেন জাহাজের খরচ দিতে। প্রস্তুতি শেষ হল সান্তা মারিয়া, পিন্টা ও নিনার এবং সাথে সাথে সহযাত্রী ৮৭ জন নাবিকের। শুরু হল তাদের যাত্রা। আটলান্টিকের অসীম জলরাশি তাদের স্বাগত জানাল। কিন্তু হায়। যাত্রাপথের প্রতিকূলতা নাবিকদের সম্পূর্ন হতাশ করে দেয়। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। কোথাও স্থলভাগের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। কলম্বাস দুটো লগ বুক রাখতেন। গুপ্ত লগবুকে সত্যিকারের দূরত্ব লিপিবদ্ধ করতেন। আর প্রকাশ্য লগবুকে অনেক কম দূরত্ব দেখানো হত। কিন্তু এভাবে করে নাবিকদের খুব বেশী দিন ফাকি দেয়া গেল না। ১০শই অক্টোবর নাবিকেরা বিদ্রোহ করে বসল। কলম্বাস বিদ্রোহী নাবিকদের কথা দিলেন দুই দিনের মধ্যে ডাংগা দেখা না গেলে তিনি ফিরে যাবেন।
অক্টোবরের ১১ তারিখ। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। আগের চেয়েও আরো বেশী পানি, চারিদিকে পানি, শুধু পানি। হঠাৎ একজন নাবিক দেখল পানিতে গাছের ডাল ভেসে আসছে। ডালে একদম সরস বেরী। ডাংগা!! খুব কাছে কোথাও রয়েছে ডাংগা!! তাদের হতাশ মনে আবারও জেগে উঠল আশা। কলম্বাস ঘোষনা দিলেন যে প্রথমে ডাংগা দেখবে, সেই লাভ করবে মূল্যবান উপহার সামগ্রী। সবাই অধীর হয়ে আছে ডাংগার জন্যে।
অক্টোবরের ১২ তারিখ। শুক্রবার ভোর দুইটা। রডরিগোয়েজ নামের নাবিকটি প্রথম ডাংগা দেখেন। কলম্বাস তার দলবল নিয়ে সেখানে অবতরন করে দ্বীপটির নামকরন করেন সান সালভাডোর দ্বীপ। এটি আজকের বাহামা দ্বীপপুন্জ্ঞের একটি। কলম্বাস ভাবলেন তিনি ভারতের কোথাও অবতরন করেছেন। কিন্তু এই ভারতীয়দের গায়ের রং যেন আলাদা - লাল বর্নের। তাই এদের ডাকলেন রেড ইন্ডিয়ানস। আমেরিকার আদিমতম অধিবাসীরা এভাবেই রেড ইন্ডিয়ান নামটি পেল।
দ্বীপের অধিবাসীরা নাবিকদের বেশ সম্মান জানালেন। কলম্বাস তার ডায়েরীতে লিখেছিলেন, "দ্বীপের অধিবাসীদের কোন ধর্ম নেই বলে মনে হচ্ছে, তাই তাদের খুব সহজে খ্রীষ্টান করা যাবে। আমি এখান থেকে ছয়জনকে নিয়ে যেতে চাই।"
কলম্বাস যখন পৌছুলেন স্পেনে তার দলবল, রেড ইন্ডিয়ান এবং সেখান থেকে নেয়া দ্রব্যাদি নিয়ে, ইসবেলা এবং ফার্ডিনান্ড তাদের আনন্দ চিত্তে বরন করলেন। এভাবে আবিষ্কৃত হল পশ্চিমের আরেকটি মহাদেশ, যোগসূত্র স্থাপিত হল ইউরোপের সাথে।
দুটি ভুলের কারনেই কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। এক, তিনি ভেবেছিলেন পশ্চিম পথে ভারতের দূরত্বে পূর্ব পথে ভারতের দূরত্বের চেয়ে কম। দ্বিতীয়ত: তিনি ভাবতে পারেন নি পশ্চিমে আটলান্টিকের পরে আরেকটি মহাসাগর অপেক্ষা করছে। প্যাসিফিক পাড়ি দিয়ে ভারতে যেতে হবে। তাই তিনি যার দূরত্ব ৩০০০ মাইল ভেবেছিলেন, তা আসলে ১০০০০ মাইল।
কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন ১২ই অক্টোবর। এই দিনটিকে প্রথম স্বীকৃতি দেন প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট। যা আমেরিকাতে কলম্বাস ডে নামে পরিচিত।
ইন্ডিয়ানদের উদ্দেশ্যে দেয়া কলম্বাসের বক্তিতার অংশ:
"ইয়োর হাইনেস, যারা স্ক্রীশ্চানিজমকে ভালবাসেন, এবং তাকে বিস্তৃত দেখতে চান, যারা মোহাম্মদীয় বিশ্বাস এবং মূর্তিপূজার শত্রু, তারা আমাকে পাঠিয়েছেন ভারতের এই প্রান্তে, যাতে করে আমাদের পবিত্র বিশ্বাসে অধিবাসীরা ধর্মান্তরিত হতে পারে। আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে যাতে আমি পূবে না যাই, যা প্রচলিত এবং জ্ঞাত একটি পথ। আমি যাতে পশ্চিম ধরে এগোই, যা আজ পর্যন্ত হয়ে রয়েছে অজানা, যে পথে আমার আগে কেউ ভ্রমন করেনি।"
০৩ রা অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১:০৩
১৪৯২ সাল। সময়টা ক্যাথলিকদের জন্য অত্যন্ত শুভ। গ্রানাডা বিজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা তারা তখন স্পেনে। রানী ইসাবেলা এবং রাজা ফার্ডিনান্ডের নেতৃত্বে ক্যাথলিকরা অবশেষে পরাভূত করতে পেরেছে মুসলিমদের। মুসলিমদের যে অযোগ্য নেতৃত্ব গ্রানাডাতে টিম টিম করে জ্বলছিল, তা সম্পূর্ন নির্বাপিত হয়ে স্পেনে আলোকিত হয়েছে ক্যাথলিকদের বিজয় মশাল।
এই শুভ ক্ষনে একজন ক্যাথলিক নাবিক কলম্বাস দেখা করতে চাইলেন রানী ইসাবেলার সাথে। রানীর সাথে কয়েক বছর আগেও তিনি দেখা করেছিলেন। কিন্তু সেবার রানীকে রাজী করাতে পারেন নি। কিন্তু এখনকার কথা তো আলাদা। এখন তো আমরা বিজয়ী। এখন নিশ্চয়ই রানী রাজী হবেন।
রানী সত্যিই রাজী হলেন কলম্বাসের কথায়। কলম্বাস তাকে আশা দিলেন পশ্চিমের নূতন গতিপথ দিয়ে ভারত আবিষ্কার করতে পারলে প্রচুর সম্পদ পৌছে যাবে রানীর কাছে। পশ্চিমের এ পথ হবে পূবের জ্ঞাত পথের চেয়ে সহজতর। এতে করে ক্যাথলিজম আরো কয়েক গুন বেশী প্রসারিত হবে। রানী যেন এ যাত্রায় সম্মতি দেন। তার যাত্রা পথের খরচ বহন করেন। রানীর পৃষ্ঠপোষকতার যে বড়ই প্রয়োজন।
রানী রাজি হলেন জাহাজের খরচ দিতে। প্রস্তুতি শেষ হল সান্তা মারিয়া, পিন্টা ও নিনার এবং সাথে সাথে সহযাত্রী ৮৭ জন নাবিকের। শুরু হল তাদের যাত্রা। আটলান্টিকের অসীম জলরাশি তাদের স্বাগত জানাল। কিন্তু হায়। যাত্রাপথের প্রতিকূলতা নাবিকদের সম্পূর্ন হতাশ করে দেয়। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। কোথাও স্থলভাগের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। কলম্বাস দুটো লগ বুক রাখতেন। গুপ্ত লগবুকে সত্যিকারের দূরত্ব লিপিবদ্ধ করতেন। আর প্রকাশ্য লগবুকে অনেক কম দূরত্ব দেখানো হত। কিন্তু এভাবে করে নাবিকদের খুব বেশী দিন ফাকি দেয়া গেল না। ১০শই অক্টোবর নাবিকেরা বিদ্রোহ করে বসল। কলম্বাস বিদ্রোহী নাবিকদের কথা দিলেন দুই দিনের মধ্যে ডাংগা দেখা না গেলে তিনি ফিরে যাবেন।
অক্টোবরের ১১ তারিখ। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। আগের চেয়েও আরো বেশী পানি, চারিদিকে পানি, শুধু পানি। হঠাৎ একজন নাবিক দেখল পানিতে গাছের ডাল ভেসে আসছে। ডালে একদম সরস বেরী। ডাংগা!! খুব কাছে কোথাও রয়েছে ডাংগা!! তাদের হতাশ মনে আবারও জেগে উঠল আশা। কলম্বাস ঘোষনা দিলেন যে প্রথমে ডাংগা দেখবে, সেই লাভ করবে মূল্যবান উপহার সামগ্রী। সবাই অধীর হয়ে আছে ডাংগার জন্যে।
অক্টোবরের ১২ তারিখ। শুক্রবার ভোর দুইটা। রডরিগোয়েজ নামের নাবিকটি প্রথম ডাংগা দেখেন। কলম্বাস তার দলবল নিয়ে সেখানে অবতরন করে দ্বীপটির নামকরন করেন সান সালভাডোর দ্বীপ। এটি আজকের বাহামা দ্বীপপুন্জ্ঞের একটি। কলম্বাস ভাবলেন তিনি ভারতের কোথাও অবতরন করেছেন। কিন্তু এই ভারতীয়দের গায়ের রং যেন আলাদা - লাল বর্নের। তাই এদের ডাকলেন রেড ইন্ডিয়ানস। আমেরিকার আদিমতম অধিবাসীরা এভাবেই রেড ইন্ডিয়ান নামটি পেল।
দ্বীপের অধিবাসীরা নাবিকদের বেশ সম্মান জানালেন। কলম্বাস তার ডায়েরীতে লিখেছিলেন, "দ্বীপের অধিবাসীদের কোন ধর্ম নেই বলে মনে হচ্ছে, তাই তাদের খুব সহজে খ্রীষ্টান করা যাবে। আমি এখান থেকে ছয়জনকে নিয়ে যেতে চাই।"
কলম্বাস যখন পৌছুলেন স্পেনে তার দলবল, রেড ইন্ডিয়ান এবং সেখান থেকে নেয়া দ্রব্যাদি নিয়ে, ইসবেলা এবং ফার্ডিনান্ড তাদের আনন্দ চিত্তে বরন করলেন। এভাবে আবিষ্কৃত হল পশ্চিমের আরেকটি মহাদেশ, যোগসূত্র স্থাপিত হল ইউরোপের সাথে।
দুটি ভুলের কারনেই কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। এক, তিনি ভেবেছিলেন পশ্চিম পথে ভারতের দূরত্বে পূর্ব পথে ভারতের দূরত্বের চেয়ে কম। দ্বিতীয়ত: তিনি ভাবতে পারেন নি পশ্চিমে আটলান্টিকের পরে আরেকটি মহাসাগর অপেক্ষা করছে। প্যাসিফিক পাড়ি দিয়ে ভারতে যেতে হবে। তাই তিনি যার দূরত্ব ৩০০০ মাইল ভেবেছিলেন, তা আসলে ১০০০০ মাইল।
কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন ১২ই অক্টোবর। এই দিনটিকে প্রথম স্বীকৃতি দেন প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট। যা আমেরিকাতে কলম্বাস ডে নামে পরিচিত।
ইন্ডিয়ানদের উদ্দেশ্যে দেয়া কলম্বাসের বক্তিতার অংশ:
"ইয়োর হাইনেস, যারা স্ক্রীশ্চানিজমকে ভালবাসেন, এবং তাকে বিস্তৃত দেখতে চান, যারা মোহাম্মদীয় বিশ্বাস এবং মূর্তিপূজার শত্রু, তারা আমাকে পাঠিয়েছেন ভারতের এই প্রান্তে, যাতে করে আমাদের পবিত্র বিশ্বাসে অধিবাসীরা ধর্মান্তরিত হতে পারে। আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে যাতে আমি পূবে না যাই, যা প্রচলিত এবং জ্ঞাত একটি পথ। আমি যাতে পশ্চিম ধরে এগোই, যা আজ পর্যন্ত হয়ে রয়েছে অজানা, যে পথে আমার আগে কেউ ভ্রমন করেনি।"
Friday, August 21, 2009
বীজগনিতের জনক আল খাওয়ারিজমী: জীবন যখন কর্মময়
[এর আগে প্রথম পর্ব দিয়েছিলাম। ষে হিসেবে এখন দ্বিতীয় পর্ব দেবার কথা। কিন্তু আগের পর্বে কিছু ভুল থাকায় ২য় পর্ব না দিয়ে পুরো লেখাটা একেবারে দিলাম।]
"হাউস অব উইসডম" এর স্কলার খাওয়ারিজমী:
সপ্তম শতকের শুরুটা মুসলিম সাম্রাজ্যের জন্য ছিল অত্যন্ত শুভ। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এশিয়া ও আফ্রিকাতে তখন মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটতে শুরু করেছে। যার ফলাফল হিসেবে আরবরা তখন বিজিত গ্রীসের গনিত বিদ্যা এবং এস্ট্রোনমির সাথে পরিচিত হতে থাকে। মুসলিম বিশ্বে সেসময়টা বিজ্ঞানের সাধনা ছিল সমাদৃত এবং গৌরবময়, যার ফলে বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক - এই দুটি দিকেই মুসলিমদের অবদান দিন দিন বেড়ে চলছিল। এরই ধারাবাহিকতায় নবম শতকে আব্বাসীয় খলিফা হারুন অর রশিদ এবং তার পুত্র মামুন কর্তৃক বাগদাদে স্থাপিত হয় "হাউস অব উইসডম", বা "বাইতুল হিকমা" নামে একটি গ্রন্থাগার, যা ছিল তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম বিদ্যপীঠ। যা তৎকালীন ক্ষমতাসীন খলিফাদের দ্বারা ব্যপক পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে জ্ঞানী গুনীদের পৃষ্ঠপোষকতায় "বাইতুল হিকমা" হয়ে উঠে অনন্য এক বিদ্যাপীঠ। এমন কি বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য থেকে বিতাড়িত জ্ঞানীদের আশ্রয় স্থল হয়ে উঠে এই "বাইতুল হিকমা"। যার ফলে ইউক্লিডিয়ান সহ বিভিন্ন গ্রীক লেখা আরবীতে অনুদিত হয়। এই অনুবাদ গুলো বিজ্ঞানের জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্ববহ কারন এর দ্বারাই অনেক মৌলিক গ্রীক রচনা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। এসময়টাতে একদিকে ইউরোপে চলছিল বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা, আর অন্য পাশে ছিল বর্বরতা এবং রাজনৈতিক দোদুল্যমনতা। যার ফলে এই কালোত্তীর্ন রচনাগুলোর বিলুপ্তি হওয়াটা কোন অসম্ভব বিষয় ছিল না। ইউরোপের পশ্চাদপদতার শূন্যস্থান পূরন হয় আরবদের এই মহতী উদ্যোগ দ্বারা। বলা চলে এগারশ শতক পর্যন্ত পৃথিবীতে গনিতের সমস্ত মৌলিক অবদানের পেছনে ছিলেন মুসলিম বিজ্ঞানীরা। বারশত শতক থেকে অন্যান্যরা মুসলিমদের এসব অবদানকে আরবী থেকে ল্যাটিন ও হিব্রুতে অনুবাদ করতে থাকে। তেরশত শতক পর্যন্ত মুসলিমদের সমমানের কোন অবদান পশ্চিমে দেখা যায় নি।
"হাউস অব উইসডম" এর এরকমই একজন স্কলার ছিলেন বাগদাদের মোহাম্মদ বিন মুসা, যিনি জন্মস্থানের নাম অনুযায়ী আলখাওয়ারিজমী নামে পরিচিত। তার জীবন সম্পর্কে খুব বেশী কিছু জানা যায় না। ধারনা করা হয় তিনি ৮৫০ শতকে ইন্তেকাল করেন। খলিফা মামুন তাকে "হাউস অব উইসডম" এ নিয়োগ দেন। এখানে তিনি গ্রীক ও সংস্কৃত বৈজ্ঞানিক শাস্ত্রের অনুবাদ অধ্যয়ন করেন। এই সম্মান ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদর্শনের জন্য তিনি মামুনের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকেন এবং নিজের রচিত অধিকাংশ বই খলিফা মামুনকে উৎসর্গ করেন। খলিফা মামুনও তার পারিশ্রমিক পরিশোধে কার্পন্য করেন নি।
বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় খাওয়ারিজমীর বৈপ্লবিক অবদানসমূহ:
এই যুগশ্রেষ্ঠ গনিতবিদ "এলজাব্রা" এবং "এলগরিদম" এর জনক, যার সাথে আজকের যুগে আমরা কমবেশী সবাই পরিচিত। গনিত শাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ন ঐতিহাসিক অবদানের মাধ্যমে তিনি বরনীয় হয়ে আছেন। এরিথমেটিক ও এলজাব্রার উপর খাওয়ারিজমীর অন্যতম একটি বইয়ের ল্যাটিন ট্রান্সলেশন "অন দ্য হিন্দু আর্ট অব রেকনিং"। বারশত শতকে তার বইয়ের ল্যাটিন অনুবাদের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্ব দশমিক সংখ্যা সিস্টেমের সাথে পরিচিত হয়। ল্যাটিনে অনুবাদ হয় "এলগোরিটমি দ্য নিউমারো ইনডোরাম" নামে। আল খাওয়ারিজমী, যাকে ল্যাটিনে "এলগোরিটমি" বলা হয়, তা থেকেই "এলগোরিদম" নামটি আসে। এই বইতে তিনি ভারতীয় সংখ্যা তত্ত্বের ব্যাখা দেন। প্রথম নয়টি সংখ্যাকে নয়টি প্রতীক এবং শূন্যকে বৃত্ত দিয়ে প্রকাশ করেন। শূন্য শব্দটি এসেছে আরবী "সিফর" থেকে যার অর্থ "শূন্য স্থান" এবং এই "সিফর" থেকে আসা শব্দ "সাইফার" যা এখন সিকিউরিটিতে বহুল ব্যবহৃত শব্দ। খাওয়ারিজমী হিন্দু শব্দ "শুণিয়া"কে আরবী অনুবাদ করেন "সিফর"। খাওয়ারিজম কর্তৃক শূন্যের প্রয়োগ ও সংখ্যার স্থানীয় স্বকীয় মানের পার্থক্যের কারনেই আজকের নম্বর সিস্টেম উদ্ভাবিত হতে পারে। সংখ্যা শাস্ত্রে তাই "শূন্য" একটি গুরুত্ব পূর্ন সংখ্যা। আবার একই সংখ্যা শতকের ঘরে থাকলে তার স্থানীয় মান এককের ঘরের চেয়ে আলাদা হয়ে থাকে। যার ফলে অনেক বিশাল বিশাল সংখ্যার প্রকাশ সহজ হয়ে যায়। এই নম্বর সিস্টেম পরবর্তীতে খাওয়ারিজমীর বইয়ের অনুবাদের মাধ্যমে ইউরোপে পরিচিতি পায়। গনিত শাস্ত্রের জন্য এটা ছিল একটি টার্নিং পয়েন্ট। আরব সংখ্যার পূর্বে পশ্চিমে প্রচলিত ছিল রোমান সংখ্যা, যা সংখ্যার প্রকাশে খুব বেশী কার্যকরী নয়। "২৮৪৩"কে মাত্র চারটি আরব সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা যাচ্ছে। অথচ রোমান নিয়ম অনুযায়ী তা হল "MMDCCCXLIII" - যার জন্য প্রয়োজন এগারটি সংখ্যার!!!!
খাওয়ারিজমী খলিফা মামুন কর্তৃক পৃথিবীর পরিধি ও ম্যাপ নির্নয়ের নিমিত্ত যে প্রজেক্ট নেয়া হয়েছিল, তার একজন ছিলেন। তিনি টলেমীর জিওগ্রাফী উপর পড়াশোনা করে টলেমীর দেয়া আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূগোলক ডেটাকে সংশোধন করেন। বিশেষত টলেমী ভূমধ্য সাগরের দৈর্ঘ্য অতিরিক্ত দেখান, যা খাওয়ারিজমী শুদ্ধ করে সঠিক ভাবে বর্ননা করেন। তার আরেকটি বই হচ্ছে "কিতাব সুরাত আল আরদ" বা "দ্য ইমেজ অব দ্য আর্থ", যাতে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের কো-অর্ডিনেট দেয়া হয়। এটা টলেমীর জিওগ্রাফীর উপর ভিত্তি করে হলেও তিনি ভূমধ্য সাগর, এশিয়া ও আফ্রিকার উপর বেশী গ্রহনযোগ্য ডাটা দেন। তিনি ও তার সতীর্থরা টেরেস্ট্রিয়াল ডিগ্রী (আকাশের এক ডিগ্রী কোনের জন্য পৃথিবীতে সৃষ্ট চাপের দৈর্ঘ্য) পরিমাপ করে পৃথিবীর ব্যাস ও পরিধি নির্নয় করেন। যার মান ছিল: পরিধি - ২০৪০০ মাইল এবং ব্যাস ৬৫০০ মাইল। প্রকৃত পক্ষে পৃথিবীর পরিধি ২৪৯০২ মাইল এবং ইকুয়েটর এলাকার ব্যাস ৭৯০০ মাইল। এই হিসাব পদ্ধতি থেকে অনুমান করা যায় পৃথিবীর গোলত্ব সম্পর্কে তাদের ধারনা ছিল।
তিনি কোনিক সেকশনের সঠিক জ্যামিতিক গঠন প্রনালী উদ্ভাবন করেন। এছাড়া ক্যালকুলাস ইত্যাদির উপরে মৌলিক অবদান রাখেন। যা থেকে পরবর্তীতে ডিফারেন্সিয়েশনের উদ্ভব হয়। খাওয়ারিজমী ইহুদী ক্যালেন্ডার, সূর্য ঘড়ি এবং এস্ট্রোলবের ব্যবহার ই্ত্যাদির উপর গবেষনা করে কয়েকটি বই লিখেন। তবে এসব অনেক বইয়ের কোন হদিস পাওয়া যায় নি। তিনি প্রায় একশত এস্ট্রোনমিক্যাল টেবল লিপিবদ্ধ করেন। শূন্যের ব্যাখা ও প্রয়োগ, সাইন ফাংশনের টেবল উদ্ভাবন সহ এস্ট্রোনমিতে বহু গুরুত্ব বহ অবদান রাখেন খাওয়ারিজমী। তার দেয়া সাইন ফাংশন পরবর্তীতে ট্যানজেন্ট ফাংশন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এস্ট্রোনমির উপর তার অবদানের কারনে তিনি সমসাময়িক কালে দ্রূত পরিচিতি পান। তার আরেকটি বই "আল-জাবরি ওয়া আল-মুকাবালাহ"তে এলজাব্রা গনিতের বিভিন্ন কনসেপ্টগুলো ব্যাখা করেন।
এলজাব্রার জনক খাওয়ারিজমী যেভাবে এলজাব্রার সূচনা করেন:
মূলত এস্টোনোমার হলেও খাওয়ারিজমী বেশী পরিচিত এলজাব্রার জনক হিসেবে। গ্রীকদের জিওমেট্রি ভিত্তিক গনিত শাস্ত্র থেকে এক ধাপ উত্তরন হচ্ছে এলজাব্রা - যার উদ্ভাবক খাওয়ারিজমী। আজকের বিশ্বে গনিতের মূল স্তম্ভ হয়ে দাড়িয়েছে এলজাব্রা। এলজাব্রার উপর খাওয়ারিজমীর মাইলস্টোন পুস্তকের আরবী নাম "আল কিতাব আল মুখতাসার ফি হিসাব আল জবর ওয়াল মুকাবালা"। ইংরেজীতে "The Compendious Book on Calculation by Completion and Balancing"। বাংলায় "তুলনা ও অবশেষের মাধ্যমে গননার সার সংক্ষেপ"। বইটির ল্যাটিন অনুবাদ ১৮৫৭ সালে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে উদ্ধার হয়। বইটির শুরু হয়েছে স্রষ্টার প্রতি ভক্তি জানিয়ে।
"এলজাব্রা" শব্দটি এসেছে "আল জবর" থেকে, যা এই বইয়ের অন্যতম প্রতিপাদ্য। মূল আরবী ক্রিয়াপদ "জাবারা", যার অর্থ "একত্রীকরন"। দ্বিঘাত সমীকরনকে সমাধান করার জন্য তিনি দুটো পদ্ধতি দেখান, যার একটি হল "আল জবর"। "আল জবর" এর শাব্দিক অর্থ সংক্ষিপ্তকরন, যাতে একটি ইকুয়েশনের দুই পাশে একই টার্ম যোগ করে নেগেটিভ টার্ম বাদ দেয়া এবং ইকুয়েশনের দুই পাশকে একই ফ্যাক্টর দিয়ে গুন করে ভগ্নাংশ মুক্ত করা হয়। "আল জবর" বা "সংক্ষিপ্ত করন" অপারেশনে একটি নেগেটিভ সংখ্যাকে ইকুয়েশনের অন্যপাশে নিয়ে তাকে পজিটিভ করা হয়। "আল মুকালাবা" শব্দটির অর্থ হচ্ছে তুলনা করা, অর্থ্যাৎ ইকুয়েশনের দুই পাশকে তুলনা করা। আরবী ভাষায় "আল জবর ওয়াল মুকাবালা" কথাটির মানে হচ্ছে "যেভাবে অ্যালজাব্রা কষতে হয়" বা "সাইন্স অব অ্যালজাব্রা"।
বইটিতে প্রথমে ছয়টি মূল ইকুয়েশনকে বিল্ডিং ব্লক হিসেবে রাখা হয়। যে কোন দ্বিঘাত সমীকরনের সমাধান কল্পে ইকুয়েশনটিকে সংক্ষেপ করে ছয়টি মূল ইকুয়েশনের যে কোন একটিতে ফেলা হয়। এখানে উল্লেখ্য আজকের দিনে ইকুয়েশনকে যেভাবে ভেরিয়েবল দিয়ে প্রকাশ করা হয়, খাওয়ারিজমী কিন্তু সেভাবে প্রকাশ করেন নি। খাওয়ারিজমীর প্রকাশ ভংগি শাব্দিক, এমন কি সংখ্যাগুলো পর্যন্ত শব্দে লেখা - "বিয়াল্লিশ" বা "চল্লিশ" এভাবে। ইকুয়েশনকে শাব্দিকভাবে প্রকাশের জন্য তিনি যেসব টার্ম বেছে নেন, তা হল "স্কয়ার" (x**2), "রুট" (x) ও "সংখ্যা" (৪২)। তার দেয়া ছয়টি মূল ইকুয়েশনকে আজকের এলজাব্রায় প্রচলিত সিম্বলের মাধ্যমে নিম্নোক্ত উপায়ে লেখা যায়:
স্কয়ার যখন রুটের সমান: ax**2 = bx
স্কয়ার যখন সংখ্যার সমান: ax**2 = c
রুট যখন সংখ্যার সমান: bx = c
স্কয়ার এবং রুট যখন সংখ্যার সমান: ax**2 + bx = c
স্কয়ার এবং সংখ্যা যখন রুটের সমান: ax**2 + c = bx
রুট ও সংখ্যা যখন স্কয়ারের সমান: bx + c = ax**2
যে কোন ইকুয়েশনকে সরলীকরন করার পর এই ছয়টির একটিতে তিনি ফেলেন। তারপর বিভিন্ন জিওমেট্রিক ও এলজাব্রিক উপায়ে ইকুয়েশনের সমাধানে পৌছেন।
আল খাওয়ারিজমীর উদাহরন দেন: x**2 = 40x − 4x**2 কে পরিবর্তন করা যায় 5x**2 = 40x. এই অপারেশনটির পুন: পুন: প্রয়োগ দ্বারা ইকুয়েশন থেকে নেগেটিভ টার্মকে বিদায় করে দেয়া যায়। অন্যদিকে "আল মুকাবালা" বা "ব্যালেন্স" অপারেশন হচ্ছে ইকুয়েশনের দুই পাশ থেকে একই রাশি বিয়োগ দেয়া। যার ফলে, x**2 + 5 = 40x + 4x**2 হয়ে যায় is 5 = 40x + 3x**2। এরকম পুন পুন অপারেশনের মাধ্যমে স্কয়ার, রুট কিংবা সংখ্যা একটি ইকুয়েশনে মাত্র একবার করে আসে। ফলে উপরে উল্লিখিত ছয়টি সমাধান যোগ্য সমীকরনের একটিতে ফেলা সম্ভব হয়ে থাকে।
এই বইয়ের পরবর্তী অংশে কিছু বাস্তব উদাহরনের সমাধান দেয়া হয়েছে উপরের নিয়ম নীতিকে অনুসরন করে। এছাড়া ক্ষেত্র ও আয়তনের কিছু সমস্যার সমাধান রয়েছে। শেষ অংশে রয়েছে মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের কিছু উদাহরন ও তা সম্পর্কিত বাস্তব সমস্যার সমাধান।
খাওয়ারিজমীর প্রসংগে বিভিন্ন স্কলারদের মূল্যায়ন:
জে ও কনর এবং রবার্টসন ম্যাক টিউটর হিস্টরী অব ম্যাথমেটিক্স এর আর্কাইভে লেখেন:
"আল খাওয়ারিজমীর নূতন আইডিয়া গ্রীক গনিতের থেকে এক বৈপ্লবিক উত্তরন, কারন গ্রীক গনিত শাস্ত্র মূলত জিওমেট্রি বেসড। ......এলজাব্রা গনিত শাস্ত্রকে একটি নূতন উন্নত পথ দেখিয়েছে যা কনসেপ্টের দিক দিয়ে অতীতের চেয়ে অনেক বিস্তৃত, এবং যা ভবিষ্যৎ উন্নয়নের কারিগড়। "
ফিলিপ হাইটির ভাষ্য:
"তিনি অন্য যে কোন মধ্য যুগীয় লেখকের চেয়ে গনিতের চিন্তাধারার উপর অনেক বেশী অবদান রাখেন।"
ইতিহাসবেত্তা জর্জ সারটুন নবম শতকের প্রথম অর্ধেককে নির্দিষ্ট করে দেন খাওয়ারিজমীর জন্যে।
একজন বিশ্বাসী হিসেবে খাওয়ারিজমী:
তিনি তার অবদানের জন্য খলিফা মামুনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে লিখেছিলেন:
"আমিরুল মুমিনিন আল মামুনকে আল্লাহ বিজ্ঞানের প্রতি আসক্তি উপহার দিয়ে ধন্য করেছেন। যে বন্ধুত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা তিনি জ্ঞানীদের প্রতি প্রদর্শন করেন, যে দ্রুততার সাথে তিনি কাঠিন্যকে সহজ করতে এবং দুর্বোধ্যকে বোধগম্য করতে সাহায্য করে থাকেন - তাই আমাকে আল জবর ও আল মুকাবালা রচনা করতে অনুপ্রানিত করেছে, যা কি না সংখ্যা শাস্ত্রের জন্য সবচেয়ে সহজ এবং দরকারী। "
- আল খাওয়ারিজমী।
(That fondness for science, by which God has distinguished the IMAN AL MAMUN, the commander of the faithful, that affability and condescension which God shows to the learned, that promptitude with which he protects and supports them in the elucidation of obscurities and in the removal of difficulties, has encouraged me to compose a short work on calculating by al-Jabr [algebra] and al-Muqabala, confining it to what is easiest and most useful in arithmetic).
একজন একনিষ্ঠ মুসলিমের মতই আল খাওয়ারিজমীও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার অবদানকে স্রষ্টার উপহার বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। খাওয়ারিজমীর বইয়ের মুখবন্ধ শুরু হয়েছে লেখকের পরিচয় ও বৃত্তান্ত দিয়ে -
মোহাম্মদ বিন মুসা, রাদি আল্লাহু আনহু ওয়া আথাবাহু ওয়া রাহেমা, অর্থ্যাৎ আল্লাহ মোহাম্মদ বিন মুসার উপর সন্তুষ্ট থাকুন এবং রহম করুন।
তিনি তার অবদানের জন্য আল্লাহর যেভাবে সন্তুষ্টি কামনা করেছেন, আমরাও উনার জন্য অনুরূপ প্রার্থনা করছি। আল্লাহ যেন তার আত্মার মাগফেরাত দেন এবং তাকে জান্নাতে দাখিল করেন।
===========================================
রেফারেন্স সাইট:
http://en.wikipedia.org/wiki/The_Compen … _Balancing
http://en.wikipedia.org/wiki/Muhammad_i … -Khwārizmī
http://knowledgerush.com/kr/encyclopedia/Al-Khawarizmi/
http://www.iidl.net/pdf/science/53359697.pdf
http://www.math10.com/en/maths-history/ … ardo2.html
http://www.muslimheritage.com/topics/de … icleID=317
http://books.google.com/books?id=8uEFaP … mp;f=false
পুনশ্চ: লেখাটির জন্য রেফারেন্স হিসেবে সবচেয়ে ডিটেইল বইটি হল: "গ্রেট মুনলিম ম্যাথমেটিশিয়ানস"। লিখেছেন "মোহাইনি মোহামেদ"। তিনি মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির এসোসিয়েট অধ্যাপিকা। http://books.google.com/books?id=8uEFaP … mp;f=false
যারা মালয়েশিয়া থাকেন, তারা কি উনার নাম শুনেছেন?
Last edited by ummu (গতকাল 22:01:40)
"হাউস অব উইসডম" এর স্কলার খাওয়ারিজমী:
সপ্তম শতকের শুরুটা মুসলিম সাম্রাজ্যের জন্য ছিল অত্যন্ত শুভ। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এশিয়া ও আফ্রিকাতে তখন মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটতে শুরু করেছে। যার ফলাফল হিসেবে আরবরা তখন বিজিত গ্রীসের গনিত বিদ্যা এবং এস্ট্রোনমির সাথে পরিচিত হতে থাকে। মুসলিম বিশ্বে সেসময়টা বিজ্ঞানের সাধনা ছিল সমাদৃত এবং গৌরবময়, যার ফলে বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক - এই দুটি দিকেই মুসলিমদের অবদান দিন দিন বেড়ে চলছিল। এরই ধারাবাহিকতায় নবম শতকে আব্বাসীয় খলিফা হারুন অর রশিদ এবং তার পুত্র মামুন কর্তৃক বাগদাদে স্থাপিত হয় "হাউস অব উইসডম", বা "বাইতুল হিকমা" নামে একটি গ্রন্থাগার, যা ছিল তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম বিদ্যপীঠ। যা তৎকালীন ক্ষমতাসীন খলিফাদের দ্বারা ব্যপক পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে জ্ঞানী গুনীদের পৃষ্ঠপোষকতায় "বাইতুল হিকমা" হয়ে উঠে অনন্য এক বিদ্যাপীঠ। এমন কি বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য থেকে বিতাড়িত জ্ঞানীদের আশ্রয় স্থল হয়ে উঠে এই "বাইতুল হিকমা"। যার ফলে ইউক্লিডিয়ান সহ বিভিন্ন গ্রীক লেখা আরবীতে অনুদিত হয়। এই অনুবাদ গুলো বিজ্ঞানের জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্ববহ কারন এর দ্বারাই অনেক মৌলিক গ্রীক রচনা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। এসময়টাতে একদিকে ইউরোপে চলছিল বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা, আর অন্য পাশে ছিল বর্বরতা এবং রাজনৈতিক দোদুল্যমনতা। যার ফলে এই কালোত্তীর্ন রচনাগুলোর বিলুপ্তি হওয়াটা কোন অসম্ভব বিষয় ছিল না। ইউরোপের পশ্চাদপদতার শূন্যস্থান পূরন হয় আরবদের এই মহতী উদ্যোগ দ্বারা। বলা চলে এগারশ শতক পর্যন্ত পৃথিবীতে গনিতের সমস্ত মৌলিক অবদানের পেছনে ছিলেন মুসলিম বিজ্ঞানীরা। বারশত শতক থেকে অন্যান্যরা মুসলিমদের এসব অবদানকে আরবী থেকে ল্যাটিন ও হিব্রুতে অনুবাদ করতে থাকে। তেরশত শতক পর্যন্ত মুসলিমদের সমমানের কোন অবদান পশ্চিমে দেখা যায় নি।
"হাউস অব উইসডম" এর এরকমই একজন স্কলার ছিলেন বাগদাদের মোহাম্মদ বিন মুসা, যিনি জন্মস্থানের নাম অনুযায়ী আলখাওয়ারিজমী নামে পরিচিত। তার জীবন সম্পর্কে খুব বেশী কিছু জানা যায় না। ধারনা করা হয় তিনি ৮৫০ শতকে ইন্তেকাল করেন। খলিফা মামুন তাকে "হাউস অব উইসডম" এ নিয়োগ দেন। এখানে তিনি গ্রীক ও সংস্কৃত বৈজ্ঞানিক শাস্ত্রের অনুবাদ অধ্যয়ন করেন। এই সম্মান ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদর্শনের জন্য তিনি মামুনের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকেন এবং নিজের রচিত অধিকাংশ বই খলিফা মামুনকে উৎসর্গ করেন। খলিফা মামুনও তার পারিশ্রমিক পরিশোধে কার্পন্য করেন নি।
বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় খাওয়ারিজমীর বৈপ্লবিক অবদানসমূহ:
এই যুগশ্রেষ্ঠ গনিতবিদ "এলজাব্রা" এবং "এলগরিদম" এর জনক, যার সাথে আজকের যুগে আমরা কমবেশী সবাই পরিচিত। গনিত শাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ন ঐতিহাসিক অবদানের মাধ্যমে তিনি বরনীয় হয়ে আছেন। এরিথমেটিক ও এলজাব্রার উপর খাওয়ারিজমীর অন্যতম একটি বইয়ের ল্যাটিন ট্রান্সলেশন "অন দ্য হিন্দু আর্ট অব রেকনিং"। বারশত শতকে তার বইয়ের ল্যাটিন অনুবাদের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্ব দশমিক সংখ্যা সিস্টেমের সাথে পরিচিত হয়। ল্যাটিনে অনুবাদ হয় "এলগোরিটমি দ্য নিউমারো ইনডোরাম" নামে। আল খাওয়ারিজমী, যাকে ল্যাটিনে "এলগোরিটমি" বলা হয়, তা থেকেই "এলগোরিদম" নামটি আসে। এই বইতে তিনি ভারতীয় সংখ্যা তত্ত্বের ব্যাখা দেন। প্রথম নয়টি সংখ্যাকে নয়টি প্রতীক এবং শূন্যকে বৃত্ত দিয়ে প্রকাশ করেন। শূন্য শব্দটি এসেছে আরবী "সিফর" থেকে যার অর্থ "শূন্য স্থান" এবং এই "সিফর" থেকে আসা শব্দ "সাইফার" যা এখন সিকিউরিটিতে বহুল ব্যবহৃত শব্দ। খাওয়ারিজমী হিন্দু শব্দ "শুণিয়া"কে আরবী অনুবাদ করেন "সিফর"। খাওয়ারিজম কর্তৃক শূন্যের প্রয়োগ ও সংখ্যার স্থানীয় স্বকীয় মানের পার্থক্যের কারনেই আজকের নম্বর সিস্টেম উদ্ভাবিত হতে পারে। সংখ্যা শাস্ত্রে তাই "শূন্য" একটি গুরুত্ব পূর্ন সংখ্যা। আবার একই সংখ্যা শতকের ঘরে থাকলে তার স্থানীয় মান এককের ঘরের চেয়ে আলাদা হয়ে থাকে। যার ফলে অনেক বিশাল বিশাল সংখ্যার প্রকাশ সহজ হয়ে যায়। এই নম্বর সিস্টেম পরবর্তীতে খাওয়ারিজমীর বইয়ের অনুবাদের মাধ্যমে ইউরোপে পরিচিতি পায়। গনিত শাস্ত্রের জন্য এটা ছিল একটি টার্নিং পয়েন্ট। আরব সংখ্যার পূর্বে পশ্চিমে প্রচলিত ছিল রোমান সংখ্যা, যা সংখ্যার প্রকাশে খুব বেশী কার্যকরী নয়। "২৮৪৩"কে মাত্র চারটি আরব সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা যাচ্ছে। অথচ রোমান নিয়ম অনুযায়ী তা হল "MMDCCCXLIII" - যার জন্য প্রয়োজন এগারটি সংখ্যার!!!!
খাওয়ারিজমী খলিফা মামুন কর্তৃক পৃথিবীর পরিধি ও ম্যাপ নির্নয়ের নিমিত্ত যে প্রজেক্ট নেয়া হয়েছিল, তার একজন ছিলেন। তিনি টলেমীর জিওগ্রাফী উপর পড়াশোনা করে টলেমীর দেয়া আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূগোলক ডেটাকে সংশোধন করেন। বিশেষত টলেমী ভূমধ্য সাগরের দৈর্ঘ্য অতিরিক্ত দেখান, যা খাওয়ারিজমী শুদ্ধ করে সঠিক ভাবে বর্ননা করেন। তার আরেকটি বই হচ্ছে "কিতাব সুরাত আল আরদ" বা "দ্য ইমেজ অব দ্য আর্থ", যাতে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের কো-অর্ডিনেট দেয়া হয়। এটা টলেমীর জিওগ্রাফীর উপর ভিত্তি করে হলেও তিনি ভূমধ্য সাগর, এশিয়া ও আফ্রিকার উপর বেশী গ্রহনযোগ্য ডাটা দেন। তিনি ও তার সতীর্থরা টেরেস্ট্রিয়াল ডিগ্রী (আকাশের এক ডিগ্রী কোনের জন্য পৃথিবীতে সৃষ্ট চাপের দৈর্ঘ্য) পরিমাপ করে পৃথিবীর ব্যাস ও পরিধি নির্নয় করেন। যার মান ছিল: পরিধি - ২০৪০০ মাইল এবং ব্যাস ৬৫০০ মাইল। প্রকৃত পক্ষে পৃথিবীর পরিধি ২৪৯০২ মাইল এবং ইকুয়েটর এলাকার ব্যাস ৭৯০০ মাইল। এই হিসাব পদ্ধতি থেকে অনুমান করা যায় পৃথিবীর গোলত্ব সম্পর্কে তাদের ধারনা ছিল।
তিনি কোনিক সেকশনের সঠিক জ্যামিতিক গঠন প্রনালী উদ্ভাবন করেন। এছাড়া ক্যালকুলাস ইত্যাদির উপরে মৌলিক অবদান রাখেন। যা থেকে পরবর্তীতে ডিফারেন্সিয়েশনের উদ্ভব হয়। খাওয়ারিজমী ইহুদী ক্যালেন্ডার, সূর্য ঘড়ি এবং এস্ট্রোলবের ব্যবহার ই্ত্যাদির উপর গবেষনা করে কয়েকটি বই লিখেন। তবে এসব অনেক বইয়ের কোন হদিস পাওয়া যায় নি। তিনি প্রায় একশত এস্ট্রোনমিক্যাল টেবল লিপিবদ্ধ করেন। শূন্যের ব্যাখা ও প্রয়োগ, সাইন ফাংশনের টেবল উদ্ভাবন সহ এস্ট্রোনমিতে বহু গুরুত্ব বহ অবদান রাখেন খাওয়ারিজমী। তার দেয়া সাইন ফাংশন পরবর্তীতে ট্যানজেন্ট ফাংশন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এস্ট্রোনমির উপর তার অবদানের কারনে তিনি সমসাময়িক কালে দ্রূত পরিচিতি পান। তার আরেকটি বই "আল-জাবরি ওয়া আল-মুকাবালাহ"তে এলজাব্রা গনিতের বিভিন্ন কনসেপ্টগুলো ব্যাখা করেন।
এলজাব্রার জনক খাওয়ারিজমী যেভাবে এলজাব্রার সূচনা করেন:
মূলত এস্টোনোমার হলেও খাওয়ারিজমী বেশী পরিচিত এলজাব্রার জনক হিসেবে। গ্রীকদের জিওমেট্রি ভিত্তিক গনিত শাস্ত্র থেকে এক ধাপ উত্তরন হচ্ছে এলজাব্রা - যার উদ্ভাবক খাওয়ারিজমী। আজকের বিশ্বে গনিতের মূল স্তম্ভ হয়ে দাড়িয়েছে এলজাব্রা। এলজাব্রার উপর খাওয়ারিজমীর মাইলস্টোন পুস্তকের আরবী নাম "আল কিতাব আল মুখতাসার ফি হিসাব আল জবর ওয়াল মুকাবালা"। ইংরেজীতে "The Compendious Book on Calculation by Completion and Balancing"। বাংলায় "তুলনা ও অবশেষের মাধ্যমে গননার সার সংক্ষেপ"। বইটির ল্যাটিন অনুবাদ ১৮৫৭ সালে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে উদ্ধার হয়। বইটির শুরু হয়েছে স্রষ্টার প্রতি ভক্তি জানিয়ে।
"এলজাব্রা" শব্দটি এসেছে "আল জবর" থেকে, যা এই বইয়ের অন্যতম প্রতিপাদ্য। মূল আরবী ক্রিয়াপদ "জাবারা", যার অর্থ "একত্রীকরন"। দ্বিঘাত সমীকরনকে সমাধান করার জন্য তিনি দুটো পদ্ধতি দেখান, যার একটি হল "আল জবর"। "আল জবর" এর শাব্দিক অর্থ সংক্ষিপ্তকরন, যাতে একটি ইকুয়েশনের দুই পাশে একই টার্ম যোগ করে নেগেটিভ টার্ম বাদ দেয়া এবং ইকুয়েশনের দুই পাশকে একই ফ্যাক্টর দিয়ে গুন করে ভগ্নাংশ মুক্ত করা হয়। "আল জবর" বা "সংক্ষিপ্ত করন" অপারেশনে একটি নেগেটিভ সংখ্যাকে ইকুয়েশনের অন্যপাশে নিয়ে তাকে পজিটিভ করা হয়। "আল মুকালাবা" শব্দটির অর্থ হচ্ছে তুলনা করা, অর্থ্যাৎ ইকুয়েশনের দুই পাশকে তুলনা করা। আরবী ভাষায় "আল জবর ওয়াল মুকাবালা" কথাটির মানে হচ্ছে "যেভাবে অ্যালজাব্রা কষতে হয়" বা "সাইন্স অব অ্যালজাব্রা"।
বইটিতে প্রথমে ছয়টি মূল ইকুয়েশনকে বিল্ডিং ব্লক হিসেবে রাখা হয়। যে কোন দ্বিঘাত সমীকরনের সমাধান কল্পে ইকুয়েশনটিকে সংক্ষেপ করে ছয়টি মূল ইকুয়েশনের যে কোন একটিতে ফেলা হয়। এখানে উল্লেখ্য আজকের দিনে ইকুয়েশনকে যেভাবে ভেরিয়েবল দিয়ে প্রকাশ করা হয়, খাওয়ারিজমী কিন্তু সেভাবে প্রকাশ করেন নি। খাওয়ারিজমীর প্রকাশ ভংগি শাব্দিক, এমন কি সংখ্যাগুলো পর্যন্ত শব্দে লেখা - "বিয়াল্লিশ" বা "চল্লিশ" এভাবে। ইকুয়েশনকে শাব্দিকভাবে প্রকাশের জন্য তিনি যেসব টার্ম বেছে নেন, তা হল "স্কয়ার" (x**2), "রুট" (x) ও "সংখ্যা" (৪২)। তার দেয়া ছয়টি মূল ইকুয়েশনকে আজকের এলজাব্রায় প্রচলিত সিম্বলের মাধ্যমে নিম্নোক্ত উপায়ে লেখা যায়:
স্কয়ার যখন রুটের সমান: ax**2 = bx
স্কয়ার যখন সংখ্যার সমান: ax**2 = c
রুট যখন সংখ্যার সমান: bx = c
স্কয়ার এবং রুট যখন সংখ্যার সমান: ax**2 + bx = c
স্কয়ার এবং সংখ্যা যখন রুটের সমান: ax**2 + c = bx
রুট ও সংখ্যা যখন স্কয়ারের সমান: bx + c = ax**2
যে কোন ইকুয়েশনকে সরলীকরন করার পর এই ছয়টির একটিতে তিনি ফেলেন। তারপর বিভিন্ন জিওমেট্রিক ও এলজাব্রিক উপায়ে ইকুয়েশনের সমাধানে পৌছেন।
আল খাওয়ারিজমীর উদাহরন দেন: x**2 = 40x − 4x**2 কে পরিবর্তন করা যায় 5x**2 = 40x. এই অপারেশনটির পুন: পুন: প্রয়োগ দ্বারা ইকুয়েশন থেকে নেগেটিভ টার্মকে বিদায় করে দেয়া যায়। অন্যদিকে "আল মুকাবালা" বা "ব্যালেন্স" অপারেশন হচ্ছে ইকুয়েশনের দুই পাশ থেকে একই রাশি বিয়োগ দেয়া। যার ফলে, x**2 + 5 = 40x + 4x**2 হয়ে যায় is 5 = 40x + 3x**2। এরকম পুন পুন অপারেশনের মাধ্যমে স্কয়ার, রুট কিংবা সংখ্যা একটি ইকুয়েশনে মাত্র একবার করে আসে। ফলে উপরে উল্লিখিত ছয়টি সমাধান যোগ্য সমীকরনের একটিতে ফেলা সম্ভব হয়ে থাকে।
এই বইয়ের পরবর্তী অংশে কিছু বাস্তব উদাহরনের সমাধান দেয়া হয়েছে উপরের নিয়ম নীতিকে অনুসরন করে। এছাড়া ক্ষেত্র ও আয়তনের কিছু সমস্যার সমাধান রয়েছে। শেষ অংশে রয়েছে মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের কিছু উদাহরন ও তা সম্পর্কিত বাস্তব সমস্যার সমাধান।
খাওয়ারিজমীর প্রসংগে বিভিন্ন স্কলারদের মূল্যায়ন:
জে ও কনর এবং রবার্টসন ম্যাক টিউটর হিস্টরী অব ম্যাথমেটিক্স এর আর্কাইভে লেখেন:
"আল খাওয়ারিজমীর নূতন আইডিয়া গ্রীক গনিতের থেকে এক বৈপ্লবিক উত্তরন, কারন গ্রীক গনিত শাস্ত্র মূলত জিওমেট্রি বেসড। ......এলজাব্রা গনিত শাস্ত্রকে একটি নূতন উন্নত পথ দেখিয়েছে যা কনসেপ্টের দিক দিয়ে অতীতের চেয়ে অনেক বিস্তৃত, এবং যা ভবিষ্যৎ উন্নয়নের কারিগড়। "
ফিলিপ হাইটির ভাষ্য:
"তিনি অন্য যে কোন মধ্য যুগীয় লেখকের চেয়ে গনিতের চিন্তাধারার উপর অনেক বেশী অবদান রাখেন।"
ইতিহাসবেত্তা জর্জ সারটুন নবম শতকের প্রথম অর্ধেককে নির্দিষ্ট করে দেন খাওয়ারিজমীর জন্যে।
একজন বিশ্বাসী হিসেবে খাওয়ারিজমী:
তিনি তার অবদানের জন্য খলিফা মামুনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে লিখেছিলেন:
"আমিরুল মুমিনিন আল মামুনকে আল্লাহ বিজ্ঞানের প্রতি আসক্তি উপহার দিয়ে ধন্য করেছেন। যে বন্ধুত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা তিনি জ্ঞানীদের প্রতি প্রদর্শন করেন, যে দ্রুততার সাথে তিনি কাঠিন্যকে সহজ করতে এবং দুর্বোধ্যকে বোধগম্য করতে সাহায্য করে থাকেন - তাই আমাকে আল জবর ও আল মুকাবালা রচনা করতে অনুপ্রানিত করেছে, যা কি না সংখ্যা শাস্ত্রের জন্য সবচেয়ে সহজ এবং দরকারী। "
- আল খাওয়ারিজমী।
(That fondness for science, by which God has distinguished the IMAN AL MAMUN, the commander of the faithful, that affability and condescension which God shows to the learned, that promptitude with which he protects and supports them in the elucidation of obscurities and in the removal of difficulties, has encouraged me to compose a short work on calculating by al-Jabr [algebra] and al-Muqabala, confining it to what is easiest and most useful in arithmetic).
একজন একনিষ্ঠ মুসলিমের মতই আল খাওয়ারিজমীও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার অবদানকে স্রষ্টার উপহার বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। খাওয়ারিজমীর বইয়ের মুখবন্ধ শুরু হয়েছে লেখকের পরিচয় ও বৃত্তান্ত দিয়ে -
মোহাম্মদ বিন মুসা, রাদি আল্লাহু আনহু ওয়া আথাবাহু ওয়া রাহেমা, অর্থ্যাৎ আল্লাহ মোহাম্মদ বিন মুসার উপর সন্তুষ্ট থাকুন এবং রহম করুন।
তিনি তার অবদানের জন্য আল্লাহর যেভাবে সন্তুষ্টি কামনা করেছেন, আমরাও উনার জন্য অনুরূপ প্রার্থনা করছি। আল্লাহ যেন তার আত্মার মাগফেরাত দেন এবং তাকে জান্নাতে দাখিল করেন।
===========================================
রেফারেন্স সাইট:
http://en.wikipedia.org/wiki/The_Compen … _Balancing
http://en.wikipedia.org/wiki/Muhammad_i … -Khwārizmī
http://knowledgerush.com/kr/encyclopedia/Al-Khawarizmi/
http://www.iidl.net/pdf/science/53359697.pdf
http://www.math10.com/en/maths-history/ … ardo2.html
http://www.muslimheritage.com/topics/de … icleID=317
http://books.google.com/books?id=8uEFaP … mp;f=false
পুনশ্চ: লেখাটির জন্য রেফারেন্স হিসেবে সবচেয়ে ডিটেইল বইটি হল: "গ্রেট মুনলিম ম্যাথমেটিশিয়ানস"। লিখেছেন "মোহাইনি মোহামেদ"। তিনি মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির এসোসিয়েট অধ্যাপিকা। http://books.google.com/books?id=8uEFaP … mp;f=false
যারা মালয়েশিয়া থাকেন, তারা কি উনার নাম শুনেছেন?
Last edited by ummu (গতকাল 22:01:40)
Friday, August 7, 2009
চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী ইবনে সিনা
স্বল্প কথায় পরিচিতি:
পশ্চিমে তিনি "দ্য প্রিন্স অব ফিজিশিয়ানস" নামে পরিচিত। তার গ্রন্থ "আল কানুন ফিল থিব" (কানুন অব মেডিসিন) চিকিৎসা শাস্ত্রের মূল অপ্রতিদ্বন্দ্বী পাঠ্য পুস্তক হিসেবে গন্য হত প্রায় পাচ শতক ধরে । যদিও তিনি ফার্মাকোলজি ও ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসের প্রভূত উন্নয়ন করেন, তার মূল অবদান ছিল মেডিসিন শাস্ত্রে। তিনি হলিস্টিক মেডিসিনের প্রনেতা - যেখানে একই সংগে শারীরীক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক যোগসূত্রকে বিবেচনায় রেখে রুগীর চিকিৎসা করা হয়। তিনিই প্রথম মানব চক্ষুর সঠিক এনাটমি করেন। যক্ষা রোগ নিয়ে তিনি অভিমত দেন যে যক্ষা একটি ছোয়াচে রোগ। যা তার পরের পশ্চিমা চিকিৎসকবৃন্দ প্রত্যাখ্যান করেন এবং যা আরো পরে সঠিক বলে প্রমানিত হয়। তিনিই প্রথম মেনিনজাইটিসকে ব্যাখা করেন। প্রকৃত পক্ষে তিনিই আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক।
এই "তিনি" আর কেউ নন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী ইবনে সিনা। যার অসংখ্য অবদানের গুটি কয়েক অবদানের কথা উপরের প্যারাতে আমি উল্লেখ করেছি। যার জীবন কিংবা কর্মের কোন শেষ নেই, তার সমস্ত অবদান উল্লেখ করার অসম্ভব কোন ইচ্ছেও আমার নেই। তার শুভাকাংখীরা তাকে জ্ঞানার্জন ও গবেষনার প্রানান্ত পরিশ্রম ত্যাগ করে জীবনকে সহজ ভাবে নেবার উপদেশ দিতেন, যা তিনি হেলায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বলা হয়, তার মাইল স্টোন পুস্তক "কানুন" লিওনার্ডো দ্য ভিনসিকেও প্রভাবিত করেছিল। "কানুন" বারশ শতকে ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত হয়ে প্রায় সতেরশ শতক পর্যন্ত পৃথিবীতে চিকিৎসা শাস্ত্রের টেক্স্ট বুক হিসেবে গন্য হত। একজন প্রথিতযশা পশ্চিমা ডক্টর "কানুন"কে "মেডিকেল বাইবেল" বলে ঘোষনা করেন। বুখারায় তার জন্ম স্থানে যে মিউজিয়াম রয়েছে তাতে তার নিবন্ধ, সার্জিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট এবং রুগীদের চিকিৎসারত অবস্থায় ছবি - এই সবই স্থান পেয়েছে। তিনি যে শুধু চিকিৎসা শাস্ত্রেই অবদান রেখেছেন তা নয়, বরং এস্ট্রোনমি সহ আরো অনেক শাখায় তার গুরুত্ব বহ অবদান রয়েছে। তিনি মোমেন্টামকে ওজন ও বেগের গুনফলের সমানুপাতিক বলে অভিমত দেন। তিনি আরো অভিমত দেন যে, হাজারো চেষ্টা করলেও সীসা বা তামা থেকে সোনা বানানো যাবে না, যা তার সময়ের অনেক বিজ্ঞানী নিরন্তর চেষ্টা করেছিলেন। তিনি শুক্র গ্রহকে পৃথিবীর চেয়ে সূর্যের অধিকতর নিকটে অবস্থিত বলে নির্নয় করেন। তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ চাদের একটি ফাটলের নাম তার নামে করা হয়েছে।
জীবদ্দশাতেই একজন সফল চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইবনে সিনা জার্জানের রাজপুত্রের চিকিৎসা করে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। এই জার্জানেই তিনি তার বিখ্যাত বই "কানুন" রচনা করেন। জার্জানের রাজপুত্র অনেক দিন ধরে অসুস্থতায় ছিলেন শয্যাশায়ী। স্থানীয় চিকিৎসকরা কিছুতেই তার অসুস্থতা ধরতে পারছিলেন না, তারা রীতিমত হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। অবশেষে ইবনে সিনার সাহায্য নেন। ইবনে সিনা খেয়াল করলেন রাজপুত্রের সামনে তার প্রেমিকার নাম উচ্চারন করতে পালসের গতি বেড়ে যায়। ইবনে সিনা সহজ ছোট্ট সমাধান দিলেন, "যুগলদের মিলিয়ে দাও।"
মেটাফিজিক্সের প্রতি তার গুরুত্ব যেভাবে এল:
প্রথমে ইবনে সিনা মেটাফিজিক্সকে স্পর্শের বাইরে বলে গুরুত্ব দেন নি। এর অধ্যয়নকে সময় নষ্ট বলে মনে করতেন। কিন্তু একটি বিকেল তাকে বদলে দিল। সে বিকেলে বইয়ের বাজারে এক বিক্রেতা তাকে অনেক কষ্টে তিন দিরহামের বিনিময়ে আরেকজন বিতর্কিত মুসলিম দার্শনিক ফারাবীর "অন দ্য অবজেক্টস অব মেটা ফিজিক্স" বইটিকে কিনতে প্ররোচিত করেন। বিক্রেতা খুব অর্থের দরকার হয়ে পড়েছিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি বইটি কেনেন। বইটি পড়ার পরে সবকিছু বদলে যায়। ফেলে আসা এরিস্টটলের মেটা ফিজিক্স দর্শনকে আবার গুরুত্ববহ মনে করেন এবং পরদিন এই কৃতজ্ঞতায় গরীবদের অর্থদান করেন। তিনি বলেন, "আমি এরিস্টটলের মেটা ফিজিক্স মোট চল্লিশ বার অধ্যয়ন করে তাকে হৃদয়ে আয়ত্ত্ব করি। তা সত্ত্বেও আমার বোঝায় ঘাটতি থেকে যায়। শেষে ফারাবীর এই বই পড়েই আমি এরিস্টটলের মেটা ফিজিক্স বুঝতে পারি।" তার দর্শনে মেটা ফিজিক্স একটি গুরুত্বপূর্ন স্থান দখল করে রয়েছে। তার অন্যতম মাইলস্টোন পুস্তক শিফাকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়: লজিক, ফিজিক্স, মেটা ফিজিক্স, ম্যাথমেটিক্স। এই মেটা ফিজিক্সের উপরে গবেষনা পরবর্তীতে তার বিরোধীদের প্রধান অস্ত্রে পরিনত হয়।
যেভাবে এল কাফের ফতোয়া:
মাত্র দশ বছর বয়েসে অসাধারন মেধাবী ইবনে সিনা হাফিজ হন। আর সতের বছর বয়েসে হন চিকিৎসক। ইবনে নিসা, ল্যাটিন ভাষায় যাকে বলা হয় "আভিসেনা", অভিযুক্ত হন মুরতাদ এবং কাফের হিসেবে। তার বিরুদ্ধে এই ফতোয়া ইস্যু করেন ইমাম গাজ্জালী।
কিন্তু কেন? ইবনে নিসাই তো প্রথম তার দর্শনে আল্লাহর অস্তিত্বকে প্রমান করার প্রয়াস নেন যা রয়েছে "শিফা"র মেটা ফিজিক্স অধ্যায়ে। তিনি এরিস্টটলের অস্তিত্ব ও করন মতবাদকে ব্যাখা করতে গিয়ে বলেন, কাজ এবং ফলাফল একই সাথে অবস্থান করে। তিনি প্রকৃতির সব কিছুকে একটি চেইনের মাধ্যমে প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, "এই চেইন অসীম হতে পারেনা, অবশ্যই সসীম যার প্রথমে রয়েছেন স্রষ্টা যিনি পরমূখাপেক্ষী নন। যা এই চেইনের একমাত্র ব্যতিক্রম।"
ইবনে সিনার প্রতি ইমাম গাজ্জালীর এই বিরোধীতার মূলে রয়েছে মেটা ফিজিক্সে ইবনে সিনার নিজস্ব দর্শন। তার বিরুদ্ধে কাফের ফতোয়া দেয়া হয় নিম্নোক্ত তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। প্রথমত: ইবনে সিনা তার দর্শনে বিশ্বকে চিরজীবী দাবী করেন যার কোন শুরু নেই। যেখানে মুসলিমরা বিশ্বাস করেন আল্লাহ শূন্য থেকে এই পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন। দ্বিতীয়ত: তিনি বলেন, আল্লাহ সৃষ্টি এবং ধ্বংস সম্পর্কে সাধারন ভাবে জানেন, কিন্তু পুংখানুপুঙ্খ ভাবে নয়। যেখানে মুসলিমরা বিশ্বাস করে থাকেন, আল্লাহ আক্ষরিক অর্থেই প্রতিটি বিষয় অবগত। তৃতীয়ত, তিনি শারীরীক পুনরুথ্থান নয়, বরং আত্মিক পুনরুথ্থানের উপর জোড় দেন। মূলত এই তিনটি কারনে ইমাম গাজালী ইবনে সিনাকে কাফের সাব্যস্ত করা বাধ্যতামূলক বলে দাবী করেন।
এখন দেখা যাক, এই আপাত বিতর্কিত্ ইস্যু গুলো নিয়ে ইবনে সিনা আসলে কি বলেছিলেন।
ইবনে সিনা এটা বিশ্বাস করতেন যে, এই বিশ্ব চিরজীবী বা আদি অন্ত বিহীন। তবে এটাও বিশ্বাস করতেন যে, বিশ্ব একটি সৃষ্ট বস্তু। তিনি ব্যাখা দেন, সৃষ্ট হবার অর্থ এই নয় যে সময়ের প্রেক্ষিতে তার কোন শুরু আছে। তিনি আরো বলেন, বিশ্বের অস্তিত্বের পেছনে কার্যকরন ও প্রয়োজন বিদ্যমান। আল্লাহ এই বিশ্বকে হতে দিয়েছেন, যার শুরু থাকতেও পারে কিংবা নাও থাকতে পারে। তবে শেষ নেই। ইমাম গাজালী চ্যালেন্জ্ঞ দিয়ে বলেন, আল্লাহ যদি একমাত্র স্বাধীন অমূখাপেক্ষী সত্ত্বা হন তবে বিশ্বকে তার পরেই সৃষ্ট হতে হবে, তা অস্তিত্ব ও সময় - দুটোরই মানদন্ডে। সুতরাং তা অনাদি অনন্ত হতে পারে না। এই দর্শনকে কুফরী বলে আখ্যায়িত করেছেন ইমাম গাজালী।
এবারে আসা যাক আল্লাহর জ্ঞানের পরিধি নিয়ে ইবনে সিনা কি বলেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহ সমস্ত খুটিনাটি বিষয় সম্পর্কে অবহিত, তবে এই জানাটা সামগ্রিক। সময়ের ভিত্তিতে তার জ্ঞানের কোন পরিবর্তন হয় না। ফলে যখন কোন ইভেন্ট সত্যি সত্যি সংঘটিত হয়, তখন তা তিনি নূতন করে জানতে পারেন না, কারন তার জ্ঞান সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয় না। ইবনে সিনা আল্লাহর "একচ্ছত্র (এবসোলিউট) জ্ঞান"কে "সময়ের সাথে অপরিবর্তনশীল" বলে ব্যাখা করেন।
("When this particular event actually occurs in time, God, not being subject to temporal change, cannot know it. But He also need not know it in this manner for He knows it already".) ইবনে সিনার স্রষ্টা সম্পর্কিত দর্শন সাদামাটা ভাষায় (আমি যা বুঝলাম) হচ্ছে : প্রকৃতির প্রতিটি নিয়ম স্রষ্টার অবগত এবং প্রকৃতির প্রতিটি বস্তু কার্যকরন, ফলাফল ও তাদের সম্পর্কের দ্বারা পরিচালিত। যেহেতু এসব বস্তু নিয়মের বাইরে নয়, এবং সেই নিয়মের খুটিনাটি স্রষ্টার অবগত, তাই এসব বস্তুর খুটিনাটি সম্পর্কে স্রষ্টার ধারনা সামগ্রিক।
সত্যি বলতে কি তার এই ডকট্রিনে আমি কোন কুফরি খুজে পাই নি। যদিও এই ডকট্রিনকেও কুফরী লেবেল সাটা হয়েছে। ইবনে সিনা "স্রষ্টার খুটিনাটি জ্ঞান" কে ব্যাখা করেছেন তার নিজের দর্শন দিয়ে। এই খুটিনাটি জ্ঞানকে তিনি অস্বীকার করেন নি মোটেও। তিনি যুক্তি এবং কার্যকরনকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, সমস্ত ঘটনা প্রবাহ নিয়মের ছকে বাধা বলেই ঘটছে। এই নিয়ম স্রষ্টার তৈরী যার ফলে কোন ঘটনা ঘটলে তা আলাদা ভাবে স্রষ্টার জানার কিছু নেই কারন তা তো নিয়মের প্রেক্ষিতেই ঘটেছে। সেন্স-পারসেপশন, যা ঘটনাপ্রবাহের উপর নির্ভর করে, তা স্রষ্টার ক্ষেত্রে খাটেনা কারন তার জ্ঞান সময়ের উর্ধ্বে এবং সময়ের সাথে অপরিবর্তনশীল। আমি যা বুঝলাম তা হল পুরো বিশ্ব এবং তার ঘটনাপ্রবাহকে একটি if-else সমৃদ্ধ প্রোগ্রাম দিয়ে প্রকাশ করা যায়, যার ইনপুট আউটপুট সহ পুরো প্রোগ্রাম স্রষ্টার জ্ঞানের সীমায়। তাই খুটিনাটি ভাবে কখন কোন পথ ধরে প্রোগ্রাম এগুচ্ছে তা তো স্রষ্টার জানার কোন প্রয়োজন নেই। যা হোক, এই ডকট্রিন তার বিরুদ্ধে ফতোয়ার ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
তাকে সবচাইতে বেশী সমালোচনা সহ্য করতে হয় যে কারনে তা হল শারীরীক পুনরুথ্থান বিষয়ে তার অবস্থান। দাবী করা হয় মৃত্যু পরবর্তী শারীরীক পুনরুথ্থানকে ইবনে সিনা অস্বীকার করেছেন। উল্লেখ্য শারীরীক পুনরুথ্থানে বিশ্বাস পোষন ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের একটি। নীচের আয়াতগুলোতে সমর্থন পাওয়া যাবে:
"মানুষ কি মনে করে যে আমরা কখনো তার হাড়গোড় একত্রিত করব না। হ্যা, আমরা তার আংগুলগুলো পর্যন্ত পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম।" (ক্কিয়ামাহ: ৩-৪)।
"তারা বলেঃ যখন আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাব, তখনও কি নতুন করে সৃজিত হয়ে উত্থিত হব? বলুনঃ তোমরা পাথর হয়ে যাও কিংবা লোহা। অথবা এমন কোন বস্তু, যা তোমাদের ধারণায় খুবই কঠিন; তথাপি তারা বলবেঃ আমাদের কে পুর্নবার কে সৃষ্টি করবে। বলুনঃ যিনি তোমাদেরকে প্রথমবার সৃজন করেছেন। অতঃপর তারা আপনার সামনে মাথা নাড়বে এবং বলবেঃ এটা কবে হবে? বলুনঃ হবে, সম্ভবতঃ শ্রীঘ্রই।" [বনী ইসরাঈল/ইসরাঃ ৪৯-৫১]
শারীরীক পুনরুথ্থানকে অস্বীকার করার জন্য ইমাম গাজ্জালী ও আরো অনেক স্কলার ইবনে সিনাকে কাফের সাব্যস্ত করা বাধ্যতামূলক বলে দাবী করেছিলেন। মূলত এই মতবাদের ভিত্তিতে ইবনে সিনার উপর কুফরী আরোপ করা হয়। এখন প্রশ্ন ইবনে সিনা কি সত্যিই শারীরীক পুনরুথ্থানকে অস্বীকার করেছিলেন? উল্লেখ্য ইবনে সিনা নিজেও বলেছেন মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে ইসলামের আলোতেই ব্যাখা করতে হবে, এছাড়া আর কোন যুক্তি গ্রাহ্য ব্যাখা নেই। ইবনে সিনা আত্মিক পুনরুথ্থানের পক্ষে নীচের আয়াতগুলো দেন:
"হে প্রশান্ত মন।
তুমি তোমার পালন কর্তার দিকে ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে।"
(ফজর : ২৭-২৮)
ফেরেশতা ও রূহ আল্লাহর দিকে ঊর্ধ্বগামী হয় (মাআরিজ : ৪)
পরবর্তী কালে যখন ইবনে সিনার দর্শনকে আরো বিশ্লেষন করা হয়, তখন দেখা যায় তিনি প্রকৃত পক্ষে শারীরীক পুনরুথ্থানকে পুরো অস্বীকার করেন নি। তিনি সুরা ওয়াকিয়াতে যে তিনটি দলের কথা বলা হয়েছে (আর তোমরা হয়ে পড়বে তিনটি শ্রেনীতে (ওয়াক্কিয়াহ : ৭)), তার তৃতীয় দলটিকে শুধু মাত্র শারীরীক পুনরুথ্থান করা হবে বলে দাবী করেছেন। বাকী দুই দল আত্মিক ভাবেই স্বর্গ লাভ করবে। তৃতীয় দলের শারীরীক পুনরুথ্থান হবে শাস্তির জন্য। সুতরাং ইবনে সিনা শারীরীক পুনরুথ্থানকে একটি বিশেষ দলের জন্য নির্ধারন করেছেন। যার ফলে ইবনে সিনা শারীরীক পুনরুথ্থানকে সম্পূর্ন অস্বীকার করেছেন - বিরোধীদের এই দাবী দুর্বল হয়ে যায়।
এখানে উল্লেখ্য ইসলামের ইতিহাসে যুক্তি এবং লজিককে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়ার সিলসিলা ইবনে সিনাই যে প্রথম শুরু করেন - তা নয়। তার আগে মুতাজিলা গোষ্ঠীও যুক্তিকে আশ্রয় করে ইসলামের অনেক বিভ্রান্তিকর ব্যাখা দেয়। অথচ তাদের প্রতি কেউ কাফের ফতোয়া ইস্যু করে নি। আমার স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা না করে থাকলে হাদীসকে শরিয়ার উৎস হিসেবে প্রথম অস্বীকার করে এই মুতাজিলা গোষ্ঠী। কারন তারা যুক্তি দিয়ে ইসলামের অনেক মৌলিক আকিদা ব্যাখা করতে চাইত, যা অনেক সময় হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হত। ইবনে সিনার দর্শনেও এই মুতাজিলা গোষ্ঠীর প্রভাব কিছুটা দেখা যায়।
ইবনে সিনা আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ ছিলেন। তিনি নিজেকে জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও একনিষ্ঠ মুসলিম বলে দাবী করতেন। তার প্রথম দুইটি দাবীর সাথে বিশ্ব একমত, যদিও তৃতীয় দাবীটি সর্বজন স্বীকৃত হয় নি। তবে পরবর্তীতে অনেকেই দাবী করেছেন কাফের ফতোয়াটা ইবনে সিনার জন্য ছিল অতিরিক্ত কঠোর একটি ফতোয়া।
কাফের ফতোয়াকে অস্বীকার করে ইবনে সিনার কবিতাটা তুলে দিলাম:
"আমার মত কাউকে ব্লাসফেমীর দায়ে অভিযুক্ত করা সহজ কিংবা সহজলভ্য নয়
আমার চেয়ে দৃঢ় বিশ্বাস আর নেই
আমার মত কেউ যদি অধার্মিক হয়ে থাকে
তবে পৃথিবীতে আর কোন মুসলিম নেই।"
পশ্চিমে তিনি "দ্য প্রিন্স অব ফিজিশিয়ানস" নামে পরিচিত। তার গ্রন্থ "আল কানুন ফিল থিব" (কানুন অব মেডিসিন) চিকিৎসা শাস্ত্রের মূল অপ্রতিদ্বন্দ্বী পাঠ্য পুস্তক হিসেবে গন্য হত প্রায় পাচ শতক ধরে । যদিও তিনি ফার্মাকোলজি ও ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসের প্রভূত উন্নয়ন করেন, তার মূল অবদান ছিল মেডিসিন শাস্ত্রে। তিনি হলিস্টিক মেডিসিনের প্রনেতা - যেখানে একই সংগে শারীরীক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক যোগসূত্রকে বিবেচনায় রেখে রুগীর চিকিৎসা করা হয়। তিনিই প্রথম মানব চক্ষুর সঠিক এনাটমি করেন। যক্ষা রোগ নিয়ে তিনি অভিমত দেন যে যক্ষা একটি ছোয়াচে রোগ। যা তার পরের পশ্চিমা চিকিৎসকবৃন্দ প্রত্যাখ্যান করেন এবং যা আরো পরে সঠিক বলে প্রমানিত হয়। তিনিই প্রথম মেনিনজাইটিসকে ব্যাখা করেন। প্রকৃত পক্ষে তিনিই আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক।
এই "তিনি" আর কেউ নন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী ইবনে সিনা। যার অসংখ্য অবদানের গুটি কয়েক অবদানের কথা উপরের প্যারাতে আমি উল্লেখ করেছি। যার জীবন কিংবা কর্মের কোন শেষ নেই, তার সমস্ত অবদান উল্লেখ করার অসম্ভব কোন ইচ্ছেও আমার নেই। তার শুভাকাংখীরা তাকে জ্ঞানার্জন ও গবেষনার প্রানান্ত পরিশ্রম ত্যাগ করে জীবনকে সহজ ভাবে নেবার উপদেশ দিতেন, যা তিনি হেলায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বলা হয়, তার মাইল স্টোন পুস্তক "কানুন" লিওনার্ডো দ্য ভিনসিকেও প্রভাবিত করেছিল। "কানুন" বারশ শতকে ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত হয়ে প্রায় সতেরশ শতক পর্যন্ত পৃথিবীতে চিকিৎসা শাস্ত্রের টেক্স্ট বুক হিসেবে গন্য হত। একজন প্রথিতযশা পশ্চিমা ডক্টর "কানুন"কে "মেডিকেল বাইবেল" বলে ঘোষনা করেন। বুখারায় তার জন্ম স্থানে যে মিউজিয়াম রয়েছে তাতে তার নিবন্ধ, সার্জিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট এবং রুগীদের চিকিৎসারত অবস্থায় ছবি - এই সবই স্থান পেয়েছে। তিনি যে শুধু চিকিৎসা শাস্ত্রেই অবদান রেখেছেন তা নয়, বরং এস্ট্রোনমি সহ আরো অনেক শাখায় তার গুরুত্ব বহ অবদান রয়েছে। তিনি মোমেন্টামকে ওজন ও বেগের গুনফলের সমানুপাতিক বলে অভিমত দেন। তিনি আরো অভিমত দেন যে, হাজারো চেষ্টা করলেও সীসা বা তামা থেকে সোনা বানানো যাবে না, যা তার সময়ের অনেক বিজ্ঞানী নিরন্তর চেষ্টা করেছিলেন। তিনি শুক্র গ্রহকে পৃথিবীর চেয়ে সূর্যের অধিকতর নিকটে অবস্থিত বলে নির্নয় করেন। তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ চাদের একটি ফাটলের নাম তার নামে করা হয়েছে।
জীবদ্দশাতেই একজন সফল চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইবনে সিনা জার্জানের রাজপুত্রের চিকিৎসা করে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। এই জার্জানেই তিনি তার বিখ্যাত বই "কানুন" রচনা করেন। জার্জানের রাজপুত্র অনেক দিন ধরে অসুস্থতায় ছিলেন শয্যাশায়ী। স্থানীয় চিকিৎসকরা কিছুতেই তার অসুস্থতা ধরতে পারছিলেন না, তারা রীতিমত হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। অবশেষে ইবনে সিনার সাহায্য নেন। ইবনে সিনা খেয়াল করলেন রাজপুত্রের সামনে তার প্রেমিকার নাম উচ্চারন করতে পালসের গতি বেড়ে যায়। ইবনে সিনা সহজ ছোট্ট সমাধান দিলেন, "যুগলদের মিলিয়ে দাও।"
মেটাফিজিক্সের প্রতি তার গুরুত্ব যেভাবে এল:
প্রথমে ইবনে সিনা মেটাফিজিক্সকে স্পর্শের বাইরে বলে গুরুত্ব দেন নি। এর অধ্যয়নকে সময় নষ্ট বলে মনে করতেন। কিন্তু একটি বিকেল তাকে বদলে দিল। সে বিকেলে বইয়ের বাজারে এক বিক্রেতা তাকে অনেক কষ্টে তিন দিরহামের বিনিময়ে আরেকজন বিতর্কিত মুসলিম দার্শনিক ফারাবীর "অন দ্য অবজেক্টস অব মেটা ফিজিক্স" বইটিকে কিনতে প্ররোচিত করেন। বিক্রেতা খুব অর্থের দরকার হয়ে পড়েছিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি বইটি কেনেন। বইটি পড়ার পরে সবকিছু বদলে যায়। ফেলে আসা এরিস্টটলের মেটা ফিজিক্স দর্শনকে আবার গুরুত্ববহ মনে করেন এবং পরদিন এই কৃতজ্ঞতায় গরীবদের অর্থদান করেন। তিনি বলেন, "আমি এরিস্টটলের মেটা ফিজিক্স মোট চল্লিশ বার অধ্যয়ন করে তাকে হৃদয়ে আয়ত্ত্ব করি। তা সত্ত্বেও আমার বোঝায় ঘাটতি থেকে যায়। শেষে ফারাবীর এই বই পড়েই আমি এরিস্টটলের মেটা ফিজিক্স বুঝতে পারি।" তার দর্শনে মেটা ফিজিক্স একটি গুরুত্বপূর্ন স্থান দখল করে রয়েছে। তার অন্যতম মাইলস্টোন পুস্তক শিফাকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়: লজিক, ফিজিক্স, মেটা ফিজিক্স, ম্যাথমেটিক্স। এই মেটা ফিজিক্সের উপরে গবেষনা পরবর্তীতে তার বিরোধীদের প্রধান অস্ত্রে পরিনত হয়।
যেভাবে এল কাফের ফতোয়া:
মাত্র দশ বছর বয়েসে অসাধারন মেধাবী ইবনে সিনা হাফিজ হন। আর সতের বছর বয়েসে হন চিকিৎসক। ইবনে নিসা, ল্যাটিন ভাষায় যাকে বলা হয় "আভিসেনা", অভিযুক্ত হন মুরতাদ এবং কাফের হিসেবে। তার বিরুদ্ধে এই ফতোয়া ইস্যু করেন ইমাম গাজ্জালী।
কিন্তু কেন? ইবনে নিসাই তো প্রথম তার দর্শনে আল্লাহর অস্তিত্বকে প্রমান করার প্রয়াস নেন যা রয়েছে "শিফা"র মেটা ফিজিক্স অধ্যায়ে। তিনি এরিস্টটলের অস্তিত্ব ও করন মতবাদকে ব্যাখা করতে গিয়ে বলেন, কাজ এবং ফলাফল একই সাথে অবস্থান করে। তিনি প্রকৃতির সব কিছুকে একটি চেইনের মাধ্যমে প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, "এই চেইন অসীম হতে পারেনা, অবশ্যই সসীম যার প্রথমে রয়েছেন স্রষ্টা যিনি পরমূখাপেক্ষী নন। যা এই চেইনের একমাত্র ব্যতিক্রম।"
ইবনে সিনার প্রতি ইমাম গাজ্জালীর এই বিরোধীতার মূলে রয়েছে মেটা ফিজিক্সে ইবনে সিনার নিজস্ব দর্শন। তার বিরুদ্ধে কাফের ফতোয়া দেয়া হয় নিম্নোক্ত তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। প্রথমত: ইবনে সিনা তার দর্শনে বিশ্বকে চিরজীবী দাবী করেন যার কোন শুরু নেই। যেখানে মুসলিমরা বিশ্বাস করেন আল্লাহ শূন্য থেকে এই পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন। দ্বিতীয়ত: তিনি বলেন, আল্লাহ সৃষ্টি এবং ধ্বংস সম্পর্কে সাধারন ভাবে জানেন, কিন্তু পুংখানুপুঙ্খ ভাবে নয়। যেখানে মুসলিমরা বিশ্বাস করে থাকেন, আল্লাহ আক্ষরিক অর্থেই প্রতিটি বিষয় অবগত। তৃতীয়ত, তিনি শারীরীক পুনরুথ্থান নয়, বরং আত্মিক পুনরুথ্থানের উপর জোড় দেন। মূলত এই তিনটি কারনে ইমাম গাজালী ইবনে সিনাকে কাফের সাব্যস্ত করা বাধ্যতামূলক বলে দাবী করেন।
এখন দেখা যাক, এই আপাত বিতর্কিত্ ইস্যু গুলো নিয়ে ইবনে সিনা আসলে কি বলেছিলেন।
ইবনে সিনা এটা বিশ্বাস করতেন যে, এই বিশ্ব চিরজীবী বা আদি অন্ত বিহীন। তবে এটাও বিশ্বাস করতেন যে, বিশ্ব একটি সৃষ্ট বস্তু। তিনি ব্যাখা দেন, সৃষ্ট হবার অর্থ এই নয় যে সময়ের প্রেক্ষিতে তার কোন শুরু আছে। তিনি আরো বলেন, বিশ্বের অস্তিত্বের পেছনে কার্যকরন ও প্রয়োজন বিদ্যমান। আল্লাহ এই বিশ্বকে হতে দিয়েছেন, যার শুরু থাকতেও পারে কিংবা নাও থাকতে পারে। তবে শেষ নেই। ইমাম গাজালী চ্যালেন্জ্ঞ দিয়ে বলেন, আল্লাহ যদি একমাত্র স্বাধীন অমূখাপেক্ষী সত্ত্বা হন তবে বিশ্বকে তার পরেই সৃষ্ট হতে হবে, তা অস্তিত্ব ও সময় - দুটোরই মানদন্ডে। সুতরাং তা অনাদি অনন্ত হতে পারে না। এই দর্শনকে কুফরী বলে আখ্যায়িত করেছেন ইমাম গাজালী।
এবারে আসা যাক আল্লাহর জ্ঞানের পরিধি নিয়ে ইবনে সিনা কি বলেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহ সমস্ত খুটিনাটি বিষয় সম্পর্কে অবহিত, তবে এই জানাটা সামগ্রিক। সময়ের ভিত্তিতে তার জ্ঞানের কোন পরিবর্তন হয় না। ফলে যখন কোন ইভেন্ট সত্যি সত্যি সংঘটিত হয়, তখন তা তিনি নূতন করে জানতে পারেন না, কারন তার জ্ঞান সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয় না। ইবনে সিনা আল্লাহর "একচ্ছত্র (এবসোলিউট) জ্ঞান"কে "সময়ের সাথে অপরিবর্তনশীল" বলে ব্যাখা করেন।
("When this particular event actually occurs in time, God, not being subject to temporal change, cannot know it. But He also need not know it in this manner for He knows it already".) ইবনে সিনার স্রষ্টা সম্পর্কিত দর্শন সাদামাটা ভাষায় (আমি যা বুঝলাম) হচ্ছে : প্রকৃতির প্রতিটি নিয়ম স্রষ্টার অবগত এবং প্রকৃতির প্রতিটি বস্তু কার্যকরন, ফলাফল ও তাদের সম্পর্কের দ্বারা পরিচালিত। যেহেতু এসব বস্তু নিয়মের বাইরে নয়, এবং সেই নিয়মের খুটিনাটি স্রষ্টার অবগত, তাই এসব বস্তুর খুটিনাটি সম্পর্কে স্রষ্টার ধারনা সামগ্রিক।
সত্যি বলতে কি তার এই ডকট্রিনে আমি কোন কুফরি খুজে পাই নি। যদিও এই ডকট্রিনকেও কুফরী লেবেল সাটা হয়েছে। ইবনে সিনা "স্রষ্টার খুটিনাটি জ্ঞান" কে ব্যাখা করেছেন তার নিজের দর্শন দিয়ে। এই খুটিনাটি জ্ঞানকে তিনি অস্বীকার করেন নি মোটেও। তিনি যুক্তি এবং কার্যকরনকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, সমস্ত ঘটনা প্রবাহ নিয়মের ছকে বাধা বলেই ঘটছে। এই নিয়ম স্রষ্টার তৈরী যার ফলে কোন ঘটনা ঘটলে তা আলাদা ভাবে স্রষ্টার জানার কিছু নেই কারন তা তো নিয়মের প্রেক্ষিতেই ঘটেছে। সেন্স-পারসেপশন, যা ঘটনাপ্রবাহের উপর নির্ভর করে, তা স্রষ্টার ক্ষেত্রে খাটেনা কারন তার জ্ঞান সময়ের উর্ধ্বে এবং সময়ের সাথে অপরিবর্তনশীল। আমি যা বুঝলাম তা হল পুরো বিশ্ব এবং তার ঘটনাপ্রবাহকে একটি if-else সমৃদ্ধ প্রোগ্রাম দিয়ে প্রকাশ করা যায়, যার ইনপুট আউটপুট সহ পুরো প্রোগ্রাম স্রষ্টার জ্ঞানের সীমায়। তাই খুটিনাটি ভাবে কখন কোন পথ ধরে প্রোগ্রাম এগুচ্ছে তা তো স্রষ্টার জানার কোন প্রয়োজন নেই। যা হোক, এই ডকট্রিন তার বিরুদ্ধে ফতোয়ার ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
তাকে সবচাইতে বেশী সমালোচনা সহ্য করতে হয় যে কারনে তা হল শারীরীক পুনরুথ্থান বিষয়ে তার অবস্থান। দাবী করা হয় মৃত্যু পরবর্তী শারীরীক পুনরুথ্থানকে ইবনে সিনা অস্বীকার করেছেন। উল্লেখ্য শারীরীক পুনরুথ্থানে বিশ্বাস পোষন ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের একটি। নীচের আয়াতগুলোতে সমর্থন পাওয়া যাবে:
"মানুষ কি মনে করে যে আমরা কখনো তার হাড়গোড় একত্রিত করব না। হ্যা, আমরা তার আংগুলগুলো পর্যন্ত পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম।" (ক্কিয়ামাহ: ৩-৪)।
"তারা বলেঃ যখন আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাব, তখনও কি নতুন করে সৃজিত হয়ে উত্থিত হব? বলুনঃ তোমরা পাথর হয়ে যাও কিংবা লোহা। অথবা এমন কোন বস্তু, যা তোমাদের ধারণায় খুবই কঠিন; তথাপি তারা বলবেঃ আমাদের কে পুর্নবার কে সৃষ্টি করবে। বলুনঃ যিনি তোমাদেরকে প্রথমবার সৃজন করেছেন। অতঃপর তারা আপনার সামনে মাথা নাড়বে এবং বলবেঃ এটা কবে হবে? বলুনঃ হবে, সম্ভবতঃ শ্রীঘ্রই।" [বনী ইসরাঈল/ইসরাঃ ৪৯-৫১]
শারীরীক পুনরুথ্থানকে অস্বীকার করার জন্য ইমাম গাজ্জালী ও আরো অনেক স্কলার ইবনে সিনাকে কাফের সাব্যস্ত করা বাধ্যতামূলক বলে দাবী করেছিলেন। মূলত এই মতবাদের ভিত্তিতে ইবনে সিনার উপর কুফরী আরোপ করা হয়। এখন প্রশ্ন ইবনে সিনা কি সত্যিই শারীরীক পুনরুথ্থানকে অস্বীকার করেছিলেন? উল্লেখ্য ইবনে সিনা নিজেও বলেছেন মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে ইসলামের আলোতেই ব্যাখা করতে হবে, এছাড়া আর কোন যুক্তি গ্রাহ্য ব্যাখা নেই। ইবনে সিনা আত্মিক পুনরুথ্থানের পক্ষে নীচের আয়াতগুলো দেন:
"হে প্রশান্ত মন।
তুমি তোমার পালন কর্তার দিকে ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে।"
(ফজর : ২৭-২৮)
ফেরেশতা ও রূহ আল্লাহর দিকে ঊর্ধ্বগামী হয় (মাআরিজ : ৪)
পরবর্তী কালে যখন ইবনে সিনার দর্শনকে আরো বিশ্লেষন করা হয়, তখন দেখা যায় তিনি প্রকৃত পক্ষে শারীরীক পুনরুথ্থানকে পুরো অস্বীকার করেন নি। তিনি সুরা ওয়াকিয়াতে যে তিনটি দলের কথা বলা হয়েছে (আর তোমরা হয়ে পড়বে তিনটি শ্রেনীতে (ওয়াক্কিয়াহ : ৭)), তার তৃতীয় দলটিকে শুধু মাত্র শারীরীক পুনরুথ্থান করা হবে বলে দাবী করেছেন। বাকী দুই দল আত্মিক ভাবেই স্বর্গ লাভ করবে। তৃতীয় দলের শারীরীক পুনরুথ্থান হবে শাস্তির জন্য। সুতরাং ইবনে সিনা শারীরীক পুনরুথ্থানকে একটি বিশেষ দলের জন্য নির্ধারন করেছেন। যার ফলে ইবনে সিনা শারীরীক পুনরুথ্থানকে সম্পূর্ন অস্বীকার করেছেন - বিরোধীদের এই দাবী দুর্বল হয়ে যায়।
এখানে উল্লেখ্য ইসলামের ইতিহাসে যুক্তি এবং লজিককে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়ার সিলসিলা ইবনে সিনাই যে প্রথম শুরু করেন - তা নয়। তার আগে মুতাজিলা গোষ্ঠীও যুক্তিকে আশ্রয় করে ইসলামের অনেক বিভ্রান্তিকর ব্যাখা দেয়। অথচ তাদের প্রতি কেউ কাফের ফতোয়া ইস্যু করে নি। আমার স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা না করে থাকলে হাদীসকে শরিয়ার উৎস হিসেবে প্রথম অস্বীকার করে এই মুতাজিলা গোষ্ঠী। কারন তারা যুক্তি দিয়ে ইসলামের অনেক মৌলিক আকিদা ব্যাখা করতে চাইত, যা অনেক সময় হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হত। ইবনে সিনার দর্শনেও এই মুতাজিলা গোষ্ঠীর প্রভাব কিছুটা দেখা যায়।
ইবনে সিনা আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ ছিলেন। তিনি নিজেকে জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও একনিষ্ঠ মুসলিম বলে দাবী করতেন। তার প্রথম দুইটি দাবীর সাথে বিশ্ব একমত, যদিও তৃতীয় দাবীটি সর্বজন স্বীকৃত হয় নি। তবে পরবর্তীতে অনেকেই দাবী করেছেন কাফের ফতোয়াটা ইবনে সিনার জন্য ছিল অতিরিক্ত কঠোর একটি ফতোয়া।
কাফের ফতোয়াকে অস্বীকার করে ইবনে সিনার কবিতাটা তুলে দিলাম:
"আমার মত কাউকে ব্লাসফেমীর দায়ে অভিযুক্ত করা সহজ কিংবা সহজলভ্য নয়
আমার চেয়ে দৃঢ় বিশ্বাস আর নেই
আমার মত কেউ যদি অধার্মিক হয়ে থাকে
তবে পৃথিবীতে আর কোন মুসলিম নেই।"
Wednesday, February 11, 2009
একটি কৈফিয়ত
প্রিয় তুমি,
আমার এ চিঠি কোনদিন তুমি পড়বে, এ অসম্ভব ভাবনা কখনই আমার মনে খেলে যায় নি। কি করেই বা পড়বে, তুমি তো এখন আর এ ভূবনের কেউ নও। এ জগতের মেয়াদ শেষ করে অনেক আগেই অন্য ভূবনে নিজের বাস গড়েছ। বড় অসময়ে চলে গেছ, তবে ফেলে গিয়েছ একরাশ স্মৃতি! আমাদের ছেড়ে বিদায় নেবার সে যাওয়াটা যেন সম্পূর্ন নয় - রেখে গিয়েছ ছায়া তোমার বংশধরদের মাঝে। দৃঢ়ভাবে নিজের আসন গেড়ে নিয়েছ এই পৃথিবীতে। বহুদূরে চলে গেছ, তবু বার বার আমরা তোমার অপার্থিব কোলাহল অনুভব করি, চারিপাশে শুনতে পাই তোমার অব্যক্ত ধ্বনি - আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে।
তোমার কাছে আমি হয়ত বা মূল্যহীন, অপাংক্তেয়। আমার কথা শোনার কোন ফুসরত তোমার কখনই ছিল না। কিংবা কখনও যদি আমার কোন কথা দুদন্ডের জন্য শুনেও থেকেছ, তবুও তা তোমার কাছে ছিল একেবারেই গুরুত্ব হীন, আবার কখনও বা উপহাসের বিষয় বস্তু। থাক না হয় সেসব কথা এখন। তবে জানবে, এত অবহেলা সত্ত্বেও আমার কাছে তুমি কোন অংশে গুরুত্বহীন নও। প্রবাসের দুর্লভ অবসরের হাজারো স্মৃতি চারনে হাজার মুখের যে মুখটি আমাকে সবচেয়ে বেশী নাড়া দিয়ে যায়, তা তোমার মুখ। প্লে ব্যাক হয়ে ভাসতে থাকে তোমার আনন্দ, অভিমান, উচ্ছাস কিংবা প্রিয় মানুষটির জন্য অপেক্ষার আকুলতা। এ পৃথিবীতে কাটিয়ে যাওয়া তোমার দিনলিপিতে প্রতিটি প্রত্যক্ষকৃত ক্ষন আমার স্মৃতিতে অম্লান। অথচ, তোমাকে তো আমি সবসময়ই ভুলতে চেয়েছি। আমার অনুভূতি থেকে বার বার সরিয়ে দিতে চেয়েছি তোমাকে, তোমার সমস্ত চিহ্নকে। সে চেষ্টার সবই নিস্ফল আর ব্যর্থ, তুমি স্বমহিমায় ঠাই করে নিয়েছ আর আমার এ নিস্ফল প্রচেষ্টায় শুধু ছেলেমানুষী এক আমোদ অনুভব করেছ।
অনেক দিন থেকে তাই ভাবছি তোমাকে চিঠি লেখার কথা। কিভাবে কি করে তোমার সাথে আমার পরিচয়, আমাদের সম্পর্ক - এইসবকে আবারো ঝালাই করা। কে জানে, হয়ত এই চিঠির মাধ্যমে তোমার ছায়া আর অশরীরী অস্তিত্বকে নাড়া দিলেও দিতে পারি। কিংবা হয়ত নয়, শুধু অন্য কারো জীবনের মাঝে যাতে তোমার জীবনের ছায়া না দেখতে পাই - সে বাসনার তীব্রতা আর আকাংখাতে এ চিঠি লিখতে আমি প্ররোচিত হয়েছি। এক ধরনের দায় বদ্ধতা বলতে পারো। যে দায়বদ্ধতা শুধু আমার নিজের কাছে, তোমাকে এবং তোমার মত হাজারো অনেককে ভালবাসার ফলশ্রুতিতে, তাদের জীবনকে সরল রৈখিক দেখতে চাওয়ার মানসিকতাতে।
তোমার সাথে আমার পরিচয় হঠাৎ। ৯০ সালের কোন এক সকালে। দিন তারিখ মনে নেই। তোমার সেদিনকার উচ্ছলতা আর সাবলীলতা আমার মত নির্লিপ্ত মানুষের চেতনাকেও স্পর্শ করেছিল। তোমার মাঝে যে কিছুটা ব্যতিক্রমতা ছিল তা আমার চোখ এড়ায় নি। তোমার জামার ডিজাইন সেসময়টাতে ততটা জনপ্রিয় ছিল না। আর দশটা মধ্যবিত্তের মতই সাদামাটা পোশাক, তবুও তা দৃষ্টি আকর্ষন করে। ফাক পেয়ে আমি তোমাকে বললাম,
- থাকো তো ঢাকাতেই। তবে হলে কেন সিট নিলে?
- নাহ, আমার এরকম যাওয়া আসা ভাল লাগে না।
- যাক, ভাল হল। তুমি আর আমি পাশাপশি রুমে। প্রতিবেশীনি। যদিও ডিপার্টমেন্ট আলাদা।
- ফার্স্ট ইয়ার তো সবার জন্য একই। প্রায় সব সাবজেক্ট একই।
সেদিন সেভাবেই পরিচয়। তুমি আর আমি আমাদের হল আর বুয়েট জীবন শুরু করি। পাশাপশি রুম, কিন্তু তোমার আমার মন মানসিকতার বিস্তর পার্থক্য প্রথম থেকেই ছিল প্রকট। তাই তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয় নি। আমরা কিছুটা এড়িয়ে চলতাম একজন অন্য জনকে। তাহলেও আমি তোমার সাহসী, আর কিছুটা বেপরোয়া চালচলনকে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখেছি। কিন্তু আমার মধ্যে তো ভাল লাগার কিছু ছিল না। তাই তুমি আমাকে পছন্দ করতে পারো নি, বন্ধুত্বের মর্যাদা কিংবা সম্মান দেয়া দূরে থাক।
মেধায় তোমার কোন কমতি ছিল না, কিন্তু সেটাকে একাডেমিক কাজে লাগানোতে ছিল তোমার উন্নাসিকতা। তুমি ক্লাসে যাবার চাইতে বরং স্বল্প পরিচিত একজনের জন্য অপেক্ষায় থাকতে বেশী ভালবাসতে। ক্রমেই সে তোমার সবচেয়ে প্রিয়জনে পরিনত হল। করিডোরে প্রতি মুহুর্তে কান সজাগ করে থাকতে কখন তোমার ডাক আসবে। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ রইল না। পরীক্ষা এলে কোনমতে উৎরে যেতে। হলের স্বাভাবিক নিয়ম নীতিকে উপেক্ষা করে তোমার যত্র তত্র ঘুরে বেড়ানো নিয়ে চারিদিকে কানাঘুষা, প্রবল সমালোচনা। যা তুমি মোটেও আমল দিলে না। একই অভিযোগে সিট ক্যানসেলের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সেসব কিছু তোমাকে মোটেও বিচলিত করে না। প্রিয় পুরুষটিই তখন তোমার কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশী মূল্যবান।
এভাবেই যদি চলতো, তাহলে হয়ত সমাপ্তি টানা খুব কঠিন হত না। আমারও এ চিঠি লেখার কোন প্রয়োজন থাকত না। শুধু একটি লাইন, "অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে কালাতিপাত করিতে লাগিল।" দিয়ে উপসংহার টানা যেত। কিন্তু উপর ওয়ালার ইচ্ছা ছিল অন্য রকম। তোমাদের সম্পর্ক বার বার টানাপোড়েনের ক্ষতে ক্ষত বিক্ষত হতে লাগল। প্রিয় মানুষটির প্রশ্নবোধক নৈতিকতা ছিল সারা ক্যাম্পাসে আলোচিত একটি বিষয়। কিন্তু তারপরও তুমি হৃদয়ের দাবীতে ছুটে যেতে তারই কাছে। ভাবতে, মানুষ বদলায়, সেও হয়ত বদলাবে।
সময় বয়ে যায়। বছর ঘুরে বছর চলে যায়। শত্রুর কথাই সঠিক হল। তুমি চূড়ান্ত ভাবে প্রতারিত হলে। শুধু প্রেমিক পুরুষের কাছে নও, বরং সাথে সাথে সহোদরার কাছেও। তোমার মাধ্যমেই তাদের ছিল পরিচয়, আর তোমাকে মাইনাস করেই তারা চুক্তিবদ্ধ হল। কি করে এত কিছু হল, তা আমার জানা নেই। কিন্তু তুমি জেনেছ, তোমাকে মেনে নিতে হয়েছে এক ভয়ংকর, আপাত অসম্ভব এক বাস্তবতাকে। তাদের বিয়ের সানাই যখন বাজল, তখন তুমি পরাজয়ের ক্লান্তিতে ক্লান্ত। অথচ তোমার প্রিয় বোনের বিয়েতে তোমারই সবচেয়ে আনন্দিত হবার কথা। সে আনন্দ ভাগ করে নেয়ার কথা প্রিয় পুরুষটির সাথে। হায় নিয়তি। সে পুরুষ তো আর তখন তোমার কেউ নয়, বরং তোমার বোনের সুইট হার্ট। যাকে একদিন পৃথিবী ভেবে তুমি সমাজ সংসার সবকিছুকে অগ্রাহ্য করেছিলে, সে এখন তোমার বোনের আচলে বাধা। এই নিষ্ঠুর প্রতারনা তোমার হৃদয়কে ভেংগে দিল। মানুষ কি করে এত দুঃখ সইতে পারে।
সে মানসিক ভারসাম্যহীনতায় তুমি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটি করলে। সে ভুল শুধু তোমার জীবনকে উলট পালট করেনি, বরং পাল্টে দিয়েছে আরো কটি জীবনকে। সেদিনের বিষন্নতা কাটাতে তুমি নিজেকে সপে দিলে অযোগ্য অপদার্থ এক গুন্ডার হাতে। তোমার বিয়ে হল পরিবারের সবার অমতে। যার কাছে আশ্রয় পেতে চাইলে, কোন অংশেই তোমাকে বটবৃক্ষের ছায়া দেবার মানসিকতা তার ছিল না। এদিকে তোমার পরিজনরা তোমার বারংবার ঔদ্ধত্যে বিমূখ হয়ে গিয়েছিল। যার কারনে তুমি হারালে তোমার স্বজনদের সহযোগিতা।
আগেই বলেছি, তোমার মেধা ছিল অতুলনীয়। স্ট্রাকচার পরীক্ষার আগে যখন পুরো হলের সবাই আতংকিত, তখনও তুমি নিশ্চিন্ত মনে করিডোরের কলামে হেলান দিয়ে প্রহর গুনতে প্রিয় মানুষটির। এতটা অমনোযোগী, অথচ বুয়েট উৎরে যেতে কোন সমস্যা হয় নি। তাই, বিয়ে নিয়ে মনোমালিন্যে পরিবারের অসহযোগিতা তোমাকে দমাতে পারেনি মোটেই। তুমি চলে এলে আমেরিকায়, শুরু করলে পি এইচ ডি, সাথে সাথে চাকুরী। জীবন সংগ্রামে হার মানার মত মেয়ে তুমি নও।
সে সময়টা আমি নিজে ছিলাম নিজের ভূবনে অবগাহনরত। কিছু বিষয় নিয়ে আমাকে দাড়াতে হয়েছে কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি। ফলে অনেকটা জন বিচ্ছিন্ন অবস্থা ছিল আমার। তাই তুমি কবে আমেরিকায় এসেছ, কিংবা চাকুরী করতে - তার খবর রাখার মত অবস্থা আমার ছিল না।
কেটে যায় দিন, মাস। তারপর সেই ভয়ংকর দিন এল। সেদিনের শুরুটা ছিল আর দশটি দিনের মতই সাধারন, সাদামাটা। ফোন বাজছে, কিন্তু আমি আমার সদ্য ভূমিষ্ট কন্যার পরিচর্যা নিয়ে ব্যস্ত। আনসারিং মেশিনে মেসেজ রাখছে আমার বুয়েট ক্লাশমেট কাম বান্ধবী। সেটা শুনে আমার পৃথিবী যেন দুলে উঠল। স্তম্ভিত অবস্থার প্রাথমিক ঝড় কেটে যেতেই আমি সব কাজ ফেলে কল ব্যাক করলাম:
: হ্যালো। ফোন করেছিলে।
: হ্যা। আমাদের সাথের নীতুকে চিনতে? ও মারা গেছে।
: মানে? কি বলছ এসব। - হতভম্ব অবস্থা কিছুটা কাটতে আমার পাল্টা প্রশ্ন।
: হয় খুন, নয় আত্মহত্যা। পুলিশ এখনও শিওর নয়। আমি এর বেশী কিছু জানি না।
: কি বলছ কিছু বুঝতে পারছি না। যাহোক, আমি দেখি এর প্রতিবেশী সুমিকে ফোন করি। ও নিশ্চয়ই জানবে।
ফোন রেখে আবার ফোন করলাম।
:হ্যালো সুমি।
: হ্যা। বলছি।
: নীতু নাকি মারা গেছে।
: কাল রাতে। ঘুমের মধ্যে।
: আর কি জানো।
: এই সকালে নীতুর স্বামী সবাইকে ফোন করে বলছে ও নাকি আত্মহত্যা করেছে।
: ও তো স্ট্রাগল করা একটা মেয়ে। আত্মহত্যা করতে যাবে কেন?
: সেটাই তো কথা। এটা খুন ছাড়া আর কিছু নয়। এখন পুলিশ ইনভেস্টিগেট করছে।
: আচ্ছা, তুমি কি কিছু জান। ওদের মধ্যে কি কোন গোলমাল তো চলছিলো?
: তা তো ছিলই। সে বাসা বদলাতে চাইতো। কিন্তু নীতু তাতে রাজী ছিল না। আগের রাতেও মানুষ ডেকে একটা সালিশ টাইপের হয়েছে।
এরই মাঝে মেয়ে আমার কেদে উঠল। মেয়ের কারনে সেদিন আর কথা আগাল না। এদিকে মাস খানেক ধরে এর ওর কাছ থেকে হাজারো স্ক্যান্ডাল শুনতে শুনতে আমি নিজেও হতভম্ব। তাই দিন কয়েক বাদে আবার সুমিকে ফোন করি।
: স্যরি সুমি। খালি দরকারে ফোন করি। কিছু মনে কর না।
: নাহ, কি ভাবব। আমিও তো অফিস নিয়ে মহাব্যস্ত।
: নীতুর ঘটনা নিয়ে অনেক কিছু শুনছি। কি বিষয়।
: কি শুনছ, জানি না। তবে নীতু যে স্বামীর হাতে খুন হয়েছে সেটা শিওর। নীতু ডিভোর্সের প্ল্যান করছিল।
: ডিভোর্স? কেন? তার বাবার হাজারো চাপ সত্ত্বেও তো সে ডিভোর্স করে নি। সেজন্য তার বাবা ভিসা পর্যন্ত প্রসেস করলেন না। আজকে এত পরে সে কেন ডিভোর্সের চিন্তা করছিল?
: আসলে এখানে তৃতীয় আরেকজন জড়িত।
: মানে? অন্য কারো সাথে নীতুর অ্যাফেয়ার চলছিলো?
: ওখানেরই এক ছেলের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠছিলো। সে ছেলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে তাদের সম্পর্কের কথা। ওটাই খুনের মোটিভ।
: কি বলছ। এটা তো ওয়ান সাইডেড হতে পারে। হয়ত নীতুর পক্ষ থেকে কোন দায় নেই।
: নাহ, ওর কাছে নীতুর একটা চিঠিও পাওয়া গেছে। খুব ডিপলি ইনভলভড ছিল। চিঠি একটা প্রমান।
আমি নীরব হইলাম। আর তেমন কিছু জানার নেই। তোমাকে সুমিও খুব ভালবাসত। তাই অনেক কিছু সে বলতে চায় নি। সুমির নীরবতা, ইতস্তত ভাব আমাকে বুঝিয়ে দেয় অনেক কিছু। আমি বুঝতে পারি তোমার এ সম্পর্ক প্লেটোনিক ছিল না। কারো কাছে দায়বদ্ধতা নিয়ে তুমি কখনও চল নি, তাই এরকম সম্পর্ক তোমার কাছে বিন্দুমাত্র অস্বাভাবিক মনে হয় নি। সন্তান কিংবা সমাজ কেউই তোমার কাছে বিবেচ্য নয়। অবলীলায় তাদের উপেক্ষা করে নিজের খুশীমত চলার কঠিনতম ক্ষমতাটুকু তোমার ছিল।
কল্পনা ছেড়ে আমি ফিরে আসি বাস্তবে। সুমিকে জিজ্ঞাসা করি:
: ওর বাচ্চাদের কি অবস্থা?
: ওদের কাস্টডি নিয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয় নি।
: এই যে আগের রাতে সালিশ টাইপের বৈঠক হল, তাতে কি হল?
: কি আর হবে। নীতু উড়িয়ে দেয় সব। বলেছে, একটা দুইটা অ্যাফেয়ার এরকম সবারই থাকে।
আমি ফোন রেখে দেই। তোমাকে ভাবতে থাকি। মৃত্যুর সময়টা ছিলে তুমি গাঢ ঘুমে। সে ঘুম আর কখনও ভাংগেনি। স্বপ্ন ভংগের বেদনা কাটাতে যে মানুষটিকে নিয়ে তুমি আবারও আশার স্বপ্ন দেখেছিলে, যার সন্তানকে তুমি পৃথিবীতে এনেছিলে - সেই ছিল তোমার ঘাতক, হত্যাকারী। যাদেরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে, তারাই তোমাকে অমর্যাদা আর প্রতারনা করেছে সবচেয়ে বেশী। যাদের জন্য সমাজ সংসারের রক্তচক্ষুকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছ, তারা তোমার অনুভূতিকে মাড়িয়ে যেতে দ্বিধা করেনি। এমন কি যার সন্তানদের পৃথিবীতে আনার দুর্বহ কষ্ট টুকু করেছ তার দ্বারাই এই পৃথিবীর আলো বাতাসের অধিকারটুকু পর্যন্ত হারিয়েছ।
শিরোনামেই বলেছি, তোমায় আমি ক্ষমা করতে পারছি না। তুমি কি ভেবেছ এই অক্ষমতা আমার প্রতি তোমার অবহেলার সে সংকীর্ন মানসিকতা থেকে সৃষ্ট? কিংবা, তোমাকে নৈতিকতার কাঠগড়ায় দাড়িয়ে তোমার বিচার করতে চাইছি? না, সেসবের কোনটাই নয়। তুমি এই বিশাল পৃথিবীতে বেচে থাকার অধিকার পাও নি - এত বড় অন্যায় সহ্য করে তুমি তো নীলকন্ঠের মত সমস্ত গরলকে শুষে নিয়েছ। কোন অভিযোগ, ক্ষোভ কিংবা সমালোচনার অবকাশ মাত্র রাখো নি।
তারপরও আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারছি না। যখন তোমার কথা ভাবি, তখন সাথে সাথে আরো দুটি শিশুর কথা আমার মনে উকি দিয়ে যায় - যারা আজ আশ্রয় হীন, ঠিকানা বিহীন। পরকীয়ার আসক্ত মা আর ঘাতক পিতার পরিচয়ই আজ তাদের সম্বল। অথচ তুমি তোমার জীবনের অপূর্নতাকে ভরিয়ে দিতে পারতে এই নিষ্পাপ দুটি শিশুর হাসি দিয়ে। তারাই হতে পারত তোমার পৃথিবী। তোমার কোলে তাদের নিরাপদ আশ্রয় হতে পারত তোমার জীবনের সবচেয়ে ব্ড় পাওয়া।
হয়ত কষ্ট পাচ্ছ আমার কথায়, কিংবা হয়ত নয়। হয়ত আগের মতই ঠোট উল্টে বুঝিয়ে দেবে, আমাকে গুরুত্ব দেবার মত মানসিকতা তোমার নেই। হয়ত তেড়ে এসে বলবে, আমি না হয় তোমার চোখে খারাপ কিন্তু তুমি কেন আমার সম্পর্কে এতসব লিখছ, কেন মানুষকে এত কথা বলছ। যদি আমাকে ভালই বাস, তবে কেন এভাবে ছোট করছ অন্যের সামনে।
সেক্ষেত্রে আমার ছোট্ট একটি কৈফিয়ত। এ চিঠিতে তোমাকে নিয়ে যেসব লিখেছি তার অনেকখানিতে রয়েছে আমার কল্পনা। তাই পাঠকের কাছে এ নিছক একটা গল্প। শুধু তুমি আর আমি জানি এ কাহিনীতে সত্যের ভাগটুকু।
আমার এ চিঠি কোনদিন তুমি পড়বে, এ অসম্ভব ভাবনা কখনই আমার মনে খেলে যায় নি। কি করেই বা পড়বে, তুমি তো এখন আর এ ভূবনের কেউ নও। এ জগতের মেয়াদ শেষ করে অনেক আগেই অন্য ভূবনে নিজের বাস গড়েছ। বড় অসময়ে চলে গেছ, তবে ফেলে গিয়েছ একরাশ স্মৃতি! আমাদের ছেড়ে বিদায় নেবার সে যাওয়াটা যেন সম্পূর্ন নয় - রেখে গিয়েছ ছায়া তোমার বংশধরদের মাঝে। দৃঢ়ভাবে নিজের আসন গেড়ে নিয়েছ এই পৃথিবীতে। বহুদূরে চলে গেছ, তবু বার বার আমরা তোমার অপার্থিব কোলাহল অনুভব করি, চারিপাশে শুনতে পাই তোমার অব্যক্ত ধ্বনি - আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে।
তোমার কাছে আমি হয়ত বা মূল্যহীন, অপাংক্তেয়। আমার কথা শোনার কোন ফুসরত তোমার কখনই ছিল না। কিংবা কখনও যদি আমার কোন কথা দুদন্ডের জন্য শুনেও থেকেছ, তবুও তা তোমার কাছে ছিল একেবারেই গুরুত্ব হীন, আবার কখনও বা উপহাসের বিষয় বস্তু। থাক না হয় সেসব কথা এখন। তবে জানবে, এত অবহেলা সত্ত্বেও আমার কাছে তুমি কোন অংশে গুরুত্বহীন নও। প্রবাসের দুর্লভ অবসরের হাজারো স্মৃতি চারনে হাজার মুখের যে মুখটি আমাকে সবচেয়ে বেশী নাড়া দিয়ে যায়, তা তোমার মুখ। প্লে ব্যাক হয়ে ভাসতে থাকে তোমার আনন্দ, অভিমান, উচ্ছাস কিংবা প্রিয় মানুষটির জন্য অপেক্ষার আকুলতা। এ পৃথিবীতে কাটিয়ে যাওয়া তোমার দিনলিপিতে প্রতিটি প্রত্যক্ষকৃত ক্ষন আমার স্মৃতিতে অম্লান। অথচ, তোমাকে তো আমি সবসময়ই ভুলতে চেয়েছি। আমার অনুভূতি থেকে বার বার সরিয়ে দিতে চেয়েছি তোমাকে, তোমার সমস্ত চিহ্নকে। সে চেষ্টার সবই নিস্ফল আর ব্যর্থ, তুমি স্বমহিমায় ঠাই করে নিয়েছ আর আমার এ নিস্ফল প্রচেষ্টায় শুধু ছেলেমানুষী এক আমোদ অনুভব করেছ।
অনেক দিন থেকে তাই ভাবছি তোমাকে চিঠি লেখার কথা। কিভাবে কি করে তোমার সাথে আমার পরিচয়, আমাদের সম্পর্ক - এইসবকে আবারো ঝালাই করা। কে জানে, হয়ত এই চিঠির মাধ্যমে তোমার ছায়া আর অশরীরী অস্তিত্বকে নাড়া দিলেও দিতে পারি। কিংবা হয়ত নয়, শুধু অন্য কারো জীবনের মাঝে যাতে তোমার জীবনের ছায়া না দেখতে পাই - সে বাসনার তীব্রতা আর আকাংখাতে এ চিঠি লিখতে আমি প্ররোচিত হয়েছি। এক ধরনের দায় বদ্ধতা বলতে পারো। যে দায়বদ্ধতা শুধু আমার নিজের কাছে, তোমাকে এবং তোমার মত হাজারো অনেককে ভালবাসার ফলশ্রুতিতে, তাদের জীবনকে সরল রৈখিক দেখতে চাওয়ার মানসিকতাতে।
তোমার সাথে আমার পরিচয় হঠাৎ। ৯০ সালের কোন এক সকালে। দিন তারিখ মনে নেই। তোমার সেদিনকার উচ্ছলতা আর সাবলীলতা আমার মত নির্লিপ্ত মানুষের চেতনাকেও স্পর্শ করেছিল। তোমার মাঝে যে কিছুটা ব্যতিক্রমতা ছিল তা আমার চোখ এড়ায় নি। তোমার জামার ডিজাইন সেসময়টাতে ততটা জনপ্রিয় ছিল না। আর দশটা মধ্যবিত্তের মতই সাদামাটা পোশাক, তবুও তা দৃষ্টি আকর্ষন করে। ফাক পেয়ে আমি তোমাকে বললাম,
- থাকো তো ঢাকাতেই। তবে হলে কেন সিট নিলে?
- নাহ, আমার এরকম যাওয়া আসা ভাল লাগে না।
- যাক, ভাল হল। তুমি আর আমি পাশাপশি রুমে। প্রতিবেশীনি। যদিও ডিপার্টমেন্ট আলাদা।
- ফার্স্ট ইয়ার তো সবার জন্য একই। প্রায় সব সাবজেক্ট একই।
সেদিন সেভাবেই পরিচয়। তুমি আর আমি আমাদের হল আর বুয়েট জীবন শুরু করি। পাশাপশি রুম, কিন্তু তোমার আমার মন মানসিকতার বিস্তর পার্থক্য প্রথম থেকেই ছিল প্রকট। তাই তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয় নি। আমরা কিছুটা এড়িয়ে চলতাম একজন অন্য জনকে। তাহলেও আমি তোমার সাহসী, আর কিছুটা বেপরোয়া চালচলনকে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখেছি। কিন্তু আমার মধ্যে তো ভাল লাগার কিছু ছিল না। তাই তুমি আমাকে পছন্দ করতে পারো নি, বন্ধুত্বের মর্যাদা কিংবা সম্মান দেয়া দূরে থাক।
মেধায় তোমার কোন কমতি ছিল না, কিন্তু সেটাকে একাডেমিক কাজে লাগানোতে ছিল তোমার উন্নাসিকতা। তুমি ক্লাসে যাবার চাইতে বরং স্বল্প পরিচিত একজনের জন্য অপেক্ষায় থাকতে বেশী ভালবাসতে। ক্রমেই সে তোমার সবচেয়ে প্রিয়জনে পরিনত হল। করিডোরে প্রতি মুহুর্তে কান সজাগ করে থাকতে কখন তোমার ডাক আসবে। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ রইল না। পরীক্ষা এলে কোনমতে উৎরে যেতে। হলের স্বাভাবিক নিয়ম নীতিকে উপেক্ষা করে তোমার যত্র তত্র ঘুরে বেড়ানো নিয়ে চারিদিকে কানাঘুষা, প্রবল সমালোচনা। যা তুমি মোটেও আমল দিলে না। একই অভিযোগে সিট ক্যানসেলের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সেসব কিছু তোমাকে মোটেও বিচলিত করে না। প্রিয় পুরুষটিই তখন তোমার কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশী মূল্যবান।
এভাবেই যদি চলতো, তাহলে হয়ত সমাপ্তি টানা খুব কঠিন হত না। আমারও এ চিঠি লেখার কোন প্রয়োজন থাকত না। শুধু একটি লাইন, "অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে কালাতিপাত করিতে লাগিল।" দিয়ে উপসংহার টানা যেত। কিন্তু উপর ওয়ালার ইচ্ছা ছিল অন্য রকম। তোমাদের সম্পর্ক বার বার টানাপোড়েনের ক্ষতে ক্ষত বিক্ষত হতে লাগল। প্রিয় মানুষটির প্রশ্নবোধক নৈতিকতা ছিল সারা ক্যাম্পাসে আলোচিত একটি বিষয়। কিন্তু তারপরও তুমি হৃদয়ের দাবীতে ছুটে যেতে তারই কাছে। ভাবতে, মানুষ বদলায়, সেও হয়ত বদলাবে।
সময় বয়ে যায়। বছর ঘুরে বছর চলে যায়। শত্রুর কথাই সঠিক হল। তুমি চূড়ান্ত ভাবে প্রতারিত হলে। শুধু প্রেমিক পুরুষের কাছে নও, বরং সাথে সাথে সহোদরার কাছেও। তোমার মাধ্যমেই তাদের ছিল পরিচয়, আর তোমাকে মাইনাস করেই তারা চুক্তিবদ্ধ হল। কি করে এত কিছু হল, তা আমার জানা নেই। কিন্তু তুমি জেনেছ, তোমাকে মেনে নিতে হয়েছে এক ভয়ংকর, আপাত অসম্ভব এক বাস্তবতাকে। তাদের বিয়ের সানাই যখন বাজল, তখন তুমি পরাজয়ের ক্লান্তিতে ক্লান্ত। অথচ তোমার প্রিয় বোনের বিয়েতে তোমারই সবচেয়ে আনন্দিত হবার কথা। সে আনন্দ ভাগ করে নেয়ার কথা প্রিয় পুরুষটির সাথে। হায় নিয়তি। সে পুরুষ তো আর তখন তোমার কেউ নয়, বরং তোমার বোনের সুইট হার্ট। যাকে একদিন পৃথিবী ভেবে তুমি সমাজ সংসার সবকিছুকে অগ্রাহ্য করেছিলে, সে এখন তোমার বোনের আচলে বাধা। এই নিষ্ঠুর প্রতারনা তোমার হৃদয়কে ভেংগে দিল। মানুষ কি করে এত দুঃখ সইতে পারে।
সে মানসিক ভারসাম্যহীনতায় তুমি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটি করলে। সে ভুল শুধু তোমার জীবনকে উলট পালট করেনি, বরং পাল্টে দিয়েছে আরো কটি জীবনকে। সেদিনের বিষন্নতা কাটাতে তুমি নিজেকে সপে দিলে অযোগ্য অপদার্থ এক গুন্ডার হাতে। তোমার বিয়ে হল পরিবারের সবার অমতে। যার কাছে আশ্রয় পেতে চাইলে, কোন অংশেই তোমাকে বটবৃক্ষের ছায়া দেবার মানসিকতা তার ছিল না। এদিকে তোমার পরিজনরা তোমার বারংবার ঔদ্ধত্যে বিমূখ হয়ে গিয়েছিল। যার কারনে তুমি হারালে তোমার স্বজনদের সহযোগিতা।
আগেই বলেছি, তোমার মেধা ছিল অতুলনীয়। স্ট্রাকচার পরীক্ষার আগে যখন পুরো হলের সবাই আতংকিত, তখনও তুমি নিশ্চিন্ত মনে করিডোরের কলামে হেলান দিয়ে প্রহর গুনতে প্রিয় মানুষটির। এতটা অমনোযোগী, অথচ বুয়েট উৎরে যেতে কোন সমস্যা হয় নি। তাই, বিয়ে নিয়ে মনোমালিন্যে পরিবারের অসহযোগিতা তোমাকে দমাতে পারেনি মোটেই। তুমি চলে এলে আমেরিকায়, শুরু করলে পি এইচ ডি, সাথে সাথে চাকুরী। জীবন সংগ্রামে হার মানার মত মেয়ে তুমি নও।
সে সময়টা আমি নিজে ছিলাম নিজের ভূবনে অবগাহনরত। কিছু বিষয় নিয়ে আমাকে দাড়াতে হয়েছে কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি। ফলে অনেকটা জন বিচ্ছিন্ন অবস্থা ছিল আমার। তাই তুমি কবে আমেরিকায় এসেছ, কিংবা চাকুরী করতে - তার খবর রাখার মত অবস্থা আমার ছিল না।
কেটে যায় দিন, মাস। তারপর সেই ভয়ংকর দিন এল। সেদিনের শুরুটা ছিল আর দশটি দিনের মতই সাধারন, সাদামাটা। ফোন বাজছে, কিন্তু আমি আমার সদ্য ভূমিষ্ট কন্যার পরিচর্যা নিয়ে ব্যস্ত। আনসারিং মেশিনে মেসেজ রাখছে আমার বুয়েট ক্লাশমেট কাম বান্ধবী। সেটা শুনে আমার পৃথিবী যেন দুলে উঠল। স্তম্ভিত অবস্থার প্রাথমিক ঝড় কেটে যেতেই আমি সব কাজ ফেলে কল ব্যাক করলাম:
: হ্যালো। ফোন করেছিলে।
: হ্যা। আমাদের সাথের নীতুকে চিনতে? ও মারা গেছে।
: মানে? কি বলছ এসব। - হতভম্ব অবস্থা কিছুটা কাটতে আমার পাল্টা প্রশ্ন।
: হয় খুন, নয় আত্মহত্যা। পুলিশ এখনও শিওর নয়। আমি এর বেশী কিছু জানি না।
: কি বলছ কিছু বুঝতে পারছি না। যাহোক, আমি দেখি এর প্রতিবেশী সুমিকে ফোন করি। ও নিশ্চয়ই জানবে।
ফোন রেখে আবার ফোন করলাম।
:হ্যালো সুমি।
: হ্যা। বলছি।
: নীতু নাকি মারা গেছে।
: কাল রাতে। ঘুমের মধ্যে।
: আর কি জানো।
: এই সকালে নীতুর স্বামী সবাইকে ফোন করে বলছে ও নাকি আত্মহত্যা করেছে।
: ও তো স্ট্রাগল করা একটা মেয়ে। আত্মহত্যা করতে যাবে কেন?
: সেটাই তো কথা। এটা খুন ছাড়া আর কিছু নয়। এখন পুলিশ ইনভেস্টিগেট করছে।
: আচ্ছা, তুমি কি কিছু জান। ওদের মধ্যে কি কোন গোলমাল তো চলছিলো?
: তা তো ছিলই। সে বাসা বদলাতে চাইতো। কিন্তু নীতু তাতে রাজী ছিল না। আগের রাতেও মানুষ ডেকে একটা সালিশ টাইপের হয়েছে।
এরই মাঝে মেয়ে আমার কেদে উঠল। মেয়ের কারনে সেদিন আর কথা আগাল না। এদিকে মাস খানেক ধরে এর ওর কাছ থেকে হাজারো স্ক্যান্ডাল শুনতে শুনতে আমি নিজেও হতভম্ব। তাই দিন কয়েক বাদে আবার সুমিকে ফোন করি।
: স্যরি সুমি। খালি দরকারে ফোন করি। কিছু মনে কর না।
: নাহ, কি ভাবব। আমিও তো অফিস নিয়ে মহাব্যস্ত।
: নীতুর ঘটনা নিয়ে অনেক কিছু শুনছি। কি বিষয়।
: কি শুনছ, জানি না। তবে নীতু যে স্বামীর হাতে খুন হয়েছে সেটা শিওর। নীতু ডিভোর্সের প্ল্যান করছিল।
: ডিভোর্স? কেন? তার বাবার হাজারো চাপ সত্ত্বেও তো সে ডিভোর্স করে নি। সেজন্য তার বাবা ভিসা পর্যন্ত প্রসেস করলেন না। আজকে এত পরে সে কেন ডিভোর্সের চিন্তা করছিল?
: আসলে এখানে তৃতীয় আরেকজন জড়িত।
: মানে? অন্য কারো সাথে নীতুর অ্যাফেয়ার চলছিলো?
: ওখানেরই এক ছেলের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠছিলো। সে ছেলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে তাদের সম্পর্কের কথা। ওটাই খুনের মোটিভ।
: কি বলছ। এটা তো ওয়ান সাইডেড হতে পারে। হয়ত নীতুর পক্ষ থেকে কোন দায় নেই।
: নাহ, ওর কাছে নীতুর একটা চিঠিও পাওয়া গেছে। খুব ডিপলি ইনভলভড ছিল। চিঠি একটা প্রমান।
আমি নীরব হইলাম। আর তেমন কিছু জানার নেই। তোমাকে সুমিও খুব ভালবাসত। তাই অনেক কিছু সে বলতে চায় নি। সুমির নীরবতা, ইতস্তত ভাব আমাকে বুঝিয়ে দেয় অনেক কিছু। আমি বুঝতে পারি তোমার এ সম্পর্ক প্লেটোনিক ছিল না। কারো কাছে দায়বদ্ধতা নিয়ে তুমি কখনও চল নি, তাই এরকম সম্পর্ক তোমার কাছে বিন্দুমাত্র অস্বাভাবিক মনে হয় নি। সন্তান কিংবা সমাজ কেউই তোমার কাছে বিবেচ্য নয়। অবলীলায় তাদের উপেক্ষা করে নিজের খুশীমত চলার কঠিনতম ক্ষমতাটুকু তোমার ছিল।
কল্পনা ছেড়ে আমি ফিরে আসি বাস্তবে। সুমিকে জিজ্ঞাসা করি:
: ওর বাচ্চাদের কি অবস্থা?
: ওদের কাস্টডি নিয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয় নি।
: এই যে আগের রাতে সালিশ টাইপের বৈঠক হল, তাতে কি হল?
: কি আর হবে। নীতু উড়িয়ে দেয় সব। বলেছে, একটা দুইটা অ্যাফেয়ার এরকম সবারই থাকে।
আমি ফোন রেখে দেই। তোমাকে ভাবতে থাকি। মৃত্যুর সময়টা ছিলে তুমি গাঢ ঘুমে। সে ঘুম আর কখনও ভাংগেনি। স্বপ্ন ভংগের বেদনা কাটাতে যে মানুষটিকে নিয়ে তুমি আবারও আশার স্বপ্ন দেখেছিলে, যার সন্তানকে তুমি পৃথিবীতে এনেছিলে - সেই ছিল তোমার ঘাতক, হত্যাকারী। যাদেরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে, তারাই তোমাকে অমর্যাদা আর প্রতারনা করেছে সবচেয়ে বেশী। যাদের জন্য সমাজ সংসারের রক্তচক্ষুকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছ, তারা তোমার অনুভূতিকে মাড়িয়ে যেতে দ্বিধা করেনি। এমন কি যার সন্তানদের পৃথিবীতে আনার দুর্বহ কষ্ট টুকু করেছ তার দ্বারাই এই পৃথিবীর আলো বাতাসের অধিকারটুকু পর্যন্ত হারিয়েছ।
শিরোনামেই বলেছি, তোমায় আমি ক্ষমা করতে পারছি না। তুমি কি ভেবেছ এই অক্ষমতা আমার প্রতি তোমার অবহেলার সে সংকীর্ন মানসিকতা থেকে সৃষ্ট? কিংবা, তোমাকে নৈতিকতার কাঠগড়ায় দাড়িয়ে তোমার বিচার করতে চাইছি? না, সেসবের কোনটাই নয়। তুমি এই বিশাল পৃথিবীতে বেচে থাকার অধিকার পাও নি - এত বড় অন্যায় সহ্য করে তুমি তো নীলকন্ঠের মত সমস্ত গরলকে শুষে নিয়েছ। কোন অভিযোগ, ক্ষোভ কিংবা সমালোচনার অবকাশ মাত্র রাখো নি।
তারপরও আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারছি না। যখন তোমার কথা ভাবি, তখন সাথে সাথে আরো দুটি শিশুর কথা আমার মনে উকি দিয়ে যায় - যারা আজ আশ্রয় হীন, ঠিকানা বিহীন। পরকীয়ার আসক্ত মা আর ঘাতক পিতার পরিচয়ই আজ তাদের সম্বল। অথচ তুমি তোমার জীবনের অপূর্নতাকে ভরিয়ে দিতে পারতে এই নিষ্পাপ দুটি শিশুর হাসি দিয়ে। তারাই হতে পারত তোমার পৃথিবী। তোমার কোলে তাদের নিরাপদ আশ্রয় হতে পারত তোমার জীবনের সবচেয়ে ব্ড় পাওয়া।
হয়ত কষ্ট পাচ্ছ আমার কথায়, কিংবা হয়ত নয়। হয়ত আগের মতই ঠোট উল্টে বুঝিয়ে দেবে, আমাকে গুরুত্ব দেবার মত মানসিকতা তোমার নেই। হয়ত তেড়ে এসে বলবে, আমি না হয় তোমার চোখে খারাপ কিন্তু তুমি কেন আমার সম্পর্কে এতসব লিখছ, কেন মানুষকে এত কথা বলছ। যদি আমাকে ভালই বাস, তবে কেন এভাবে ছোট করছ অন্যের সামনে।
সেক্ষেত্রে আমার ছোট্ট একটি কৈফিয়ত। এ চিঠিতে তোমাকে নিয়ে যেসব লিখেছি তার অনেকখানিতে রয়েছে আমার কল্পনা। তাই পাঠকের কাছে এ নিছক একটা গল্প। শুধু তুমি আর আমি জানি এ কাহিনীতে সত্যের ভাগটুকু।
Subscribe to:
Posts (Atom)