Monday, January 19, 2009

new post

পনের বছর আগে বিয়ে নামক শিকলের বেড়ী পায়ে পড়ার পরেও আমি বেশ কিছু দিন বুঝতে পারিনি বন্দীত্বকে। হাড়ে হাড়ে উপলদ্ধি করি সেদিন, যেদিন জন্ম হল আমার ছেলের। থমকে পড়ল যেন আমার সমস্ত প্রানোচ্ছলতা। বলতে গেলে স্বাধীনতার মূল্যটুকু টের পেলাম সেদিন, যেদিন এই অমূল্য সম্পদ চিরতরে বিসর্জিত হয়েছে। কিন্তু জীবন তো বয়ে চলা এক নদীর মত, যার মূল গতি কখনও থেমে থাকে না। তাই আমিও এই বন্দীপ্রায় জীবনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে চাইলাম। হারানোর দুঃখকে ভুলতে চাইলাম মাতৃত্বের আনন্দ দিয়ে। যে আনন্দ সৃষ্টির অবর্ননীয় আনন্দ। স্বাধীনতা হারানোর অব্যক্ত বেদনা কাটিয়ে দিল ছোট একটি শিশুর নির্মল হাসি। দিনের পর দিন একঘেয়ে গৃহবন্দী জীবনের আমার একমাত্র বৈচিত্র্য তার বিষ্ময় ভরা দৃষ্টি! বিষ্ময় ভরা দৃষ্টিতে সে এই পৃথিবীকে বোঝার চেষ্টা করে। তার সে দৃষ্টিতে থাকে আমার প্রতি নির্ভরতা। আমিই হয়ে যাই তার বিশ্বাস আর আস্থার কেন্দ্রবিন্দু। আমিও তার সমস্ত অনুভূতি আর বিষ্ময়কে নিজের মাঝে ধরে রাখতে চাইলাম। দেখলাম, কি অবাক বিষ্ময়ে সে স্বাগতম জানিয়ে বরন করেছে আরো একটি শিশুকে। আমি শিকলে আরো বেশী আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেলাম।

সেদিন থেকে আমার দিন গুলো যেন ছকে বাধা পাজল। একবার সলভড হয়ে গেলে সে পাজলে আর খুব বেশী বৈচিত্র্য নেই। দিনের কোন ক্ষনে আমার কি ডিউটি তা আগে ভাগে ঠিক করা এবং সে অনুযায়ী মাথায় প্রোগ্রাম করে রাখা। ফলে সকাল থেকে উঠে মোটামুটি এক ধ্যনের ব্যস্ততায় সারা দিনের সময়টা কেটে যায় অনেকটা রোবটের মত করে।

সকালের অংশটুকু দিনের অন্য সময়ের চেয়ে আমার কিছুটা বেশী ব্যস্ত যায়। ঘুম থেকে উঠে মেয়েকে গোসল করাও, ড্রেস পড়াও, স্কুলে দেবার জন্যে এদের টিফিন বানাও ইত্যাদি হাজারোটা কাজে কখন যে সময় বয়ে যায় কে জানে। বার বার ঘড়ির দিকে সকরুন ভাবে তাকিয়ে আল্লাহ আল্লাহ করি যাতে সময়ের করুনাটুকু কপালে জোটে। এদের যাতে সময়মত স্কুলে দিতে পারি। এদিকে ভেতরে ভেতরে একটা ভয় কাজ করে মেয়ে না আবার বেকে বসে স্কুলে না যাওয়ার জন্যে। এই কাজটা সে মাঝে মধ্যে করে থাকে। ঘুম থেকে উঠে ঘোষনা দেয়া যে স্কুলে যাবে না। সেসব দিন কাটে ভীষন ভয়াবহ। বহু সাধ্য সাধনার পরে, এটা ওটা কিনে দেবার প্রতিশ্রুতির পরে তাকে স্কুলে পাঠানো যায়। প্রতিটি প্রতিশ্রুত বস্তু তাকে দিতে হয় সপ্তাহ শেষ হবার আগেই।

এই ব্লগের আর দশ জনের মত আমার দুই শিশুর পাকাপোক্ত ধারনা যে আমার মাথায় গোবর ছাড়া আসলে আর কিছু নেই। ছেলে বিরক্ত হয়ে দাবী আমি অংক করিয়ে দিলে সেটা সবসময় হয় ভুল। মেয়েও মনে করে আম্মুর দেখানো পড়া টিচার ঠিক মনে করে না। গম্ভীর হয়ে সে জানায় আমার কাছে পড়তে মোটেও আগ্রহী নয়। হিউম্যান কমিউনিকেশনের পুরো ব্যপারটি আসলে ডুপ্লেক্স, মানে দ্বিপাক্ষিক। তারা আমার সংগ পছন্দ করেনা বলে আমার নিজেরও তাদের পড়াশোনা দেখানোর প্রতি বেশী আগ্রহ নেই। নিজেরা যা পারে, সেটাই তারা হোম ওয়ার্ক করে। আমি বেশী একটা নাক গলাই না। করুক, তারা নিজেদের মত করে। তবে মাঝে মাঝে কিছু বাংলা কবিতা পড়ে শোনাই। অবাক হয়ে দেখি সেটা আবার তাদের খুব আকর্ষন করে। আমি আবৃতির ঢং এ যখন বলি,

মনে ভাবিলাম মোরে ভগবান রাখিবে না মোহ গর্তে
তাই লিখে দিল বিশ্ব নিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।

আমার ছেলে তখন নিবিষ্ট ভংগিতে শুনতে থাকে। তাদের নিষ্পাপ চোখের মুগ্ধতা আমাকে একরাশ আনন্দ দেয়। একে একে শোনাই কাজলা দিদি, পুরাতন ভৃত্য, সোনার তরী - ঠাই নাই ঠাই নাই ছোট সে তরী। তার মনোযোগের যেন অন্ত নেই। আগ্রহী শ্রোতা পেয়ে আমারও বেশ ভাল লাগে। কখনও কখনও সে আব্দার তোলে ইংরেজী করে দিতে। সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে - এর ইংরেজী কি। আমি বুঝিয়ে দেই। বলি, এটা হল মেটাফোর যা তুমি কয়েকদিন আগে পড়লে। বাতাসে শ্বাস ফেলা মানে জোড়ে বাতাস বয়ে, বুঝলে। আর মেয়ে ভাংগা ভাংগা বাংলায় আমাকে অনুকরন করার চেষ্টা করে: মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই। ট্রান্সলেশনের আব্দার সেও করে থাকে। মাঝে মাঝে আমিও পাল্টা আব্দার তুলি। তাদেরকে বলি, বাংলা বোঝার চেষ্টা করতে। কিন্তু অবধারিত ভাবেই আমিই সবসময় হেরে যাই তাদের কাছে।

বিভোর হয়ে আবৃতি শুনতে ভালবাসলেও বাংলাদেশের যে ব্যপারটিতে তাদের কোন কৌতুহল নেই - তা হল রাজনীতি। আমি বিভিন্ন সময় খালেদা, হাসিনা, মইন ইত্যাদি নামগুলো এবং তাদের তাৎপর্য এদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছি। কিন্তু এরা মোটেও এসবে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায় নি। এটা আমার কিছুটা অবাক করে। বিশেষত আমার ছেলে যেখানে নিজের পড়ার ঘরে বাংলাদেশের ম্যাপ ঝুলিয়েছে, ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশের ব্যপারে সবসময়ই উৎসাহী। তাই ভেবেছিলাম হয়ত বাংলাদেশের নির্বাচন বা রাজনীতি নিয়েও কিছুটা কৌতুহল থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু হতাশ হয়ে দেখলাম সে গুড়ে বালি ছাড়া আর কিছু নেই। খালেদা হাসিনা নামগুলো পর্যন্ত শুনতে চায় না।

বাংলাদেশের রাজনীতি বিষয়ে নির্লিপ্ত হলেও এরা কিন্তু আমেরিকার রাজনীতি নিয়ে মাঝে মাঝে গবেষনা করে। ওবামা না ম্যাককেইন, কার কপালে শিকে জুটবে - সেটা তাদের চলে তুমুল আলোচনা। কে প্রেসিডেন্ট হলে কি নীতি নেবে এসবেও তাদের আগ্রহের কমতি নেই। তাদের বাবাও যোগ দেয় তাদের আলাপচারিতায়। কিন্তু যেই বাংলাদেশের রাজনীতির প্রসংগ উঠানোর চেষ্টা আমি করি তেমনি এরা সবাই চুপসে যায় ফাটা বেলুনের মত। আমি রাগ করে তাদের বাবাকে বলি,"এরা না হয় আমেরিকান। কিন্তু তুমি কেন বাংলাদেশ বাদ দিয়ে আমেরিকার রাজনীতি নিয়ে এত ভাবছ।" তাদের বাবার তখন সহজ জবাব, "যেখানে আছি সেখানকারটাই তো বেশী গুরুত্বপূর্ন।" বলা বাহুল্য আমি তার সাথে এ ব্যপারে মোটেও একমত নই।

আর দশটা মায়ের মতই আমি খুব সাধারন। তারা পরীক্ষায় খারাপ করলে আমি মন খারাপ করি, কিংবা খাওয়া দাওয়া কম করলে আমি বিরক্ত হই, অথবা সামান্য অসুখেই দুশ্চিন্তায় ভূগি। তা সত্ত্বেও আমি একটি ব্যপারে অন্যদের থেকে কিছুটা হলেও স্বতন্ত্র। তা হলো, আমি কখনও এদের উপর স্পাইং করি না। আমার প্রতিবেশীরা যেখানে তাদের সন্তানদের ফোন, ইন্টারনেট সহ প্রতিটি গতিবিধির উপর নজরদারি করে, আমি সেখানে তাদের লাগাম অনেকটাই ছেড়ে রেখেছি। এটা আমার নীতিবোধ আর রুচিবোধ - দুটোতেই বাধে। এছাড়া আমি নিজেও ছোটবেলায় এ ব্যপারে ভূক্তভোগী ছিলাম। সে মর্ম যন্ত্রনা কি তা ভালই মনে করতে পারি। সেজন্যে আমি তাদের বিশ্বাস করতে চাই। এ সংসারে বিশ্বাস করে ঠকাও ভাল, কিন্তু অবিশ্বাস করে পাপের ভাগী হবার কোন মানে নেই। আর আমার বিশ্বাস এরা আমাকে ঠকাবে না।

এখন উঠতে হচ্ছে বাচ্চাদের স্কুল থেকে আনার জন্য। আমার অবসর কথনের আপাতত ইতি টানতে হচ্ছে। এই লেখাটা যখন শুরু করেছিলাম তখন ছিল গভীর রাত। চারিদিকের শুনশান নীরবতার এক রাত। কেমন অলৌকিক একটা অনুভূতি যেন চিন্তা চেতনাকে গ্রাস করে। যেন কবরের অসীম নির্জনতা। আর এখন যখন শেষ করছি তখন দুপুরের নির্জনতা - পুরো বাড়ীতে আমি একা। আহ, কি শান্ত সৌম্য আর প্রশান্তিদায়ক এ নির্জনতা। দুর্লভ অবসরের পাওয়া এ নির্জনতায় ব্লগের পাতা ভরে দিলাম আমার খুব সাদামাটা দিনের খুব সাদামাটা কিছু কথায়।