[এর আগে প্রথম পর্ব দিয়েছিলাম। ষে হিসেবে এখন দ্বিতীয় পর্ব দেবার কথা। কিন্তু আগের পর্বে কিছু ভুল থাকায় ২য় পর্ব না দিয়ে পুরো লেখাটা একেবারে দিলাম।]
"হাউস অব উইসডম" এর স্কলার খাওয়ারিজমী:
সপ্তম শতকের শুরুটা মুসলিম সাম্রাজ্যের জন্য ছিল অত্যন্ত শুভ। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এশিয়া ও আফ্রিকাতে তখন মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটতে শুরু করেছে। যার ফলাফল হিসেবে আরবরা তখন বিজিত গ্রীসের গনিত বিদ্যা এবং এস্ট্রোনমির সাথে পরিচিত হতে থাকে। মুসলিম বিশ্বে সেসময়টা বিজ্ঞানের সাধনা ছিল সমাদৃত এবং গৌরবময়, যার ফলে বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক - এই দুটি দিকেই মুসলিমদের অবদান দিন দিন বেড়ে চলছিল। এরই ধারাবাহিকতায় নবম শতকে আব্বাসীয় খলিফা হারুন অর রশিদ এবং তার পুত্র মামুন কর্তৃক বাগদাদে স্থাপিত হয় "হাউস অব উইসডম", বা "বাইতুল হিকমা" নামে একটি গ্রন্থাগার, যা ছিল তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম বিদ্যপীঠ। যা তৎকালীন ক্ষমতাসীন খলিফাদের দ্বারা ব্যপক পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে জ্ঞানী গুনীদের পৃষ্ঠপোষকতায় "বাইতুল হিকমা" হয়ে উঠে অনন্য এক বিদ্যাপীঠ। এমন কি বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য থেকে বিতাড়িত জ্ঞানীদের আশ্রয় স্থল হয়ে উঠে এই "বাইতুল হিকমা"। যার ফলে ইউক্লিডিয়ান সহ বিভিন্ন গ্রীক লেখা আরবীতে অনুদিত হয়। এই অনুবাদ গুলো বিজ্ঞানের জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্ববহ কারন এর দ্বারাই অনেক মৌলিক গ্রীক রচনা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। এসময়টাতে একদিকে ইউরোপে চলছিল বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা, আর অন্য পাশে ছিল বর্বরতা এবং রাজনৈতিক দোদুল্যমনতা। যার ফলে এই কালোত্তীর্ন রচনাগুলোর বিলুপ্তি হওয়াটা কোন অসম্ভব বিষয় ছিল না। ইউরোপের পশ্চাদপদতার শূন্যস্থান পূরন হয় আরবদের এই মহতী উদ্যোগ দ্বারা। বলা চলে এগারশ শতক পর্যন্ত পৃথিবীতে গনিতের সমস্ত মৌলিক অবদানের পেছনে ছিলেন মুসলিম বিজ্ঞানীরা। বারশত শতক থেকে অন্যান্যরা মুসলিমদের এসব অবদানকে আরবী থেকে ল্যাটিন ও হিব্রুতে অনুবাদ করতে থাকে। তেরশত শতক পর্যন্ত মুসলিমদের সমমানের কোন অবদান পশ্চিমে দেখা যায় নি।
"হাউস অব উইসডম" এর এরকমই একজন স্কলার ছিলেন বাগদাদের মোহাম্মদ বিন মুসা, যিনি জন্মস্থানের নাম অনুযায়ী আলখাওয়ারিজমী নামে পরিচিত। তার জীবন সম্পর্কে খুব বেশী কিছু জানা যায় না। ধারনা করা হয় তিনি ৮৫০ শতকে ইন্তেকাল করেন। খলিফা মামুন তাকে "হাউস অব উইসডম" এ নিয়োগ দেন। এখানে তিনি গ্রীক ও সংস্কৃত বৈজ্ঞানিক শাস্ত্রের অনুবাদ অধ্যয়ন করেন। এই সম্মান ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদর্শনের জন্য তিনি মামুনের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকেন এবং নিজের রচিত অধিকাংশ বই খলিফা মামুনকে উৎসর্গ করেন। খলিফা মামুনও তার পারিশ্রমিক পরিশোধে কার্পন্য করেন নি।
বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় খাওয়ারিজমীর বৈপ্লবিক অবদানসমূহ:
এই যুগশ্রেষ্ঠ গনিতবিদ "এলজাব্রা" এবং "এলগরিদম" এর জনক, যার সাথে আজকের যুগে আমরা কমবেশী সবাই পরিচিত। গনিত শাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ন ঐতিহাসিক অবদানের মাধ্যমে তিনি বরনীয় হয়ে আছেন। এরিথমেটিক ও এলজাব্রার উপর খাওয়ারিজমীর অন্যতম একটি বইয়ের ল্যাটিন ট্রান্সলেশন "অন দ্য হিন্দু আর্ট অব রেকনিং"। বারশত শতকে তার বইয়ের ল্যাটিন অনুবাদের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্ব দশমিক সংখ্যা সিস্টেমের সাথে পরিচিত হয়। ল্যাটিনে অনুবাদ হয় "এলগোরিটমি দ্য নিউমারো ইনডোরাম" নামে। আল খাওয়ারিজমী, যাকে ল্যাটিনে "এলগোরিটমি" বলা হয়, তা থেকেই "এলগোরিদম" নামটি আসে। এই বইতে তিনি ভারতীয় সংখ্যা তত্ত্বের ব্যাখা দেন। প্রথম নয়টি সংখ্যাকে নয়টি প্রতীক এবং শূন্যকে বৃত্ত দিয়ে প্রকাশ করেন। শূন্য শব্দটি এসেছে আরবী "সিফর" থেকে যার অর্থ "শূন্য স্থান" এবং এই "সিফর" থেকে আসা শব্দ "সাইফার" যা এখন সিকিউরিটিতে বহুল ব্যবহৃত শব্দ। খাওয়ারিজমী হিন্দু শব্দ "শুণিয়া"কে আরবী অনুবাদ করেন "সিফর"। খাওয়ারিজম কর্তৃক শূন্যের প্রয়োগ ও সংখ্যার স্থানীয় স্বকীয় মানের পার্থক্যের কারনেই আজকের নম্বর সিস্টেম উদ্ভাবিত হতে পারে। সংখ্যা শাস্ত্রে তাই "শূন্য" একটি গুরুত্ব পূর্ন সংখ্যা। আবার একই সংখ্যা শতকের ঘরে থাকলে তার স্থানীয় মান এককের ঘরের চেয়ে আলাদা হয়ে থাকে। যার ফলে অনেক বিশাল বিশাল সংখ্যার প্রকাশ সহজ হয়ে যায়। এই নম্বর সিস্টেম পরবর্তীতে খাওয়ারিজমীর বইয়ের অনুবাদের মাধ্যমে ইউরোপে পরিচিতি পায়। গনিত শাস্ত্রের জন্য এটা ছিল একটি টার্নিং পয়েন্ট। আরব সংখ্যার পূর্বে পশ্চিমে প্রচলিত ছিল রোমান সংখ্যা, যা সংখ্যার প্রকাশে খুব বেশী কার্যকরী নয়। "২৮৪৩"কে মাত্র চারটি আরব সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা যাচ্ছে। অথচ রোমান নিয়ম অনুযায়ী তা হল "MMDCCCXLIII" - যার জন্য প্রয়োজন এগারটি সংখ্যার!!!!
খাওয়ারিজমী খলিফা মামুন কর্তৃক পৃথিবীর পরিধি ও ম্যাপ নির্নয়ের নিমিত্ত যে প্রজেক্ট নেয়া হয়েছিল, তার একজন ছিলেন। তিনি টলেমীর জিওগ্রাফী উপর পড়াশোনা করে টলেমীর দেয়া আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূগোলক ডেটাকে সংশোধন করেন। বিশেষত টলেমী ভূমধ্য সাগরের দৈর্ঘ্য অতিরিক্ত দেখান, যা খাওয়ারিজমী শুদ্ধ করে সঠিক ভাবে বর্ননা করেন। তার আরেকটি বই হচ্ছে "কিতাব সুরাত আল আরদ" বা "দ্য ইমেজ অব দ্য আর্থ", যাতে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের কো-অর্ডিনেট দেয়া হয়। এটা টলেমীর জিওগ্রাফীর উপর ভিত্তি করে হলেও তিনি ভূমধ্য সাগর, এশিয়া ও আফ্রিকার উপর বেশী গ্রহনযোগ্য ডাটা দেন। তিনি ও তার সতীর্থরা টেরেস্ট্রিয়াল ডিগ্রী (আকাশের এক ডিগ্রী কোনের জন্য পৃথিবীতে সৃষ্ট চাপের দৈর্ঘ্য) পরিমাপ করে পৃথিবীর ব্যাস ও পরিধি নির্নয় করেন। যার মান ছিল: পরিধি - ২০৪০০ মাইল এবং ব্যাস ৬৫০০ মাইল। প্রকৃত পক্ষে পৃথিবীর পরিধি ২৪৯০২ মাইল এবং ইকুয়েটর এলাকার ব্যাস ৭৯০০ মাইল। এই হিসাব পদ্ধতি থেকে অনুমান করা যায় পৃথিবীর গোলত্ব সম্পর্কে তাদের ধারনা ছিল।
তিনি কোনিক সেকশনের সঠিক জ্যামিতিক গঠন প্রনালী উদ্ভাবন করেন। এছাড়া ক্যালকুলাস ইত্যাদির উপরে মৌলিক অবদান রাখেন। যা থেকে পরবর্তীতে ডিফারেন্সিয়েশনের উদ্ভব হয়। খাওয়ারিজমী ইহুদী ক্যালেন্ডার, সূর্য ঘড়ি এবং এস্ট্রোলবের ব্যবহার ই্ত্যাদির উপর গবেষনা করে কয়েকটি বই লিখেন। তবে এসব অনেক বইয়ের কোন হদিস পাওয়া যায় নি। তিনি প্রায় একশত এস্ট্রোনমিক্যাল টেবল লিপিবদ্ধ করেন। শূন্যের ব্যাখা ও প্রয়োগ, সাইন ফাংশনের টেবল উদ্ভাবন সহ এস্ট্রোনমিতে বহু গুরুত্ব বহ অবদান রাখেন খাওয়ারিজমী। তার দেয়া সাইন ফাংশন পরবর্তীতে ট্যানজেন্ট ফাংশন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এস্ট্রোনমির উপর তার অবদানের কারনে তিনি সমসাময়িক কালে দ্রূত পরিচিতি পান। তার আরেকটি বই "আল-জাবরি ওয়া আল-মুকাবালাহ"তে এলজাব্রা গনিতের বিভিন্ন কনসেপ্টগুলো ব্যাখা করেন।
এলজাব্রার জনক খাওয়ারিজমী যেভাবে এলজাব্রার সূচনা করেন:
মূলত এস্টোনোমার হলেও খাওয়ারিজমী বেশী পরিচিত এলজাব্রার জনক হিসেবে। গ্রীকদের জিওমেট্রি ভিত্তিক গনিত শাস্ত্র থেকে এক ধাপ উত্তরন হচ্ছে এলজাব্রা - যার উদ্ভাবক খাওয়ারিজমী। আজকের বিশ্বে গনিতের মূল স্তম্ভ হয়ে দাড়িয়েছে এলজাব্রা। এলজাব্রার উপর খাওয়ারিজমীর মাইলস্টোন পুস্তকের আরবী নাম "আল কিতাব আল মুখতাসার ফি হিসাব আল জবর ওয়াল মুকাবালা"। ইংরেজীতে "The Compendious Book on Calculation by Completion and Balancing"। বাংলায় "তুলনা ও অবশেষের মাধ্যমে গননার সার সংক্ষেপ"। বইটির ল্যাটিন অনুবাদ ১৮৫৭ সালে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে উদ্ধার হয়। বইটির শুরু হয়েছে স্রষ্টার প্রতি ভক্তি জানিয়ে।
"এলজাব্রা" শব্দটি এসেছে "আল জবর" থেকে, যা এই বইয়ের অন্যতম প্রতিপাদ্য। মূল আরবী ক্রিয়াপদ "জাবারা", যার অর্থ "একত্রীকরন"। দ্বিঘাত সমীকরনকে সমাধান করার জন্য তিনি দুটো পদ্ধতি দেখান, যার একটি হল "আল জবর"। "আল জবর" এর শাব্দিক অর্থ সংক্ষিপ্তকরন, যাতে একটি ইকুয়েশনের দুই পাশে একই টার্ম যোগ করে নেগেটিভ টার্ম বাদ দেয়া এবং ইকুয়েশনের দুই পাশকে একই ফ্যাক্টর দিয়ে গুন করে ভগ্নাংশ মুক্ত করা হয়। "আল জবর" বা "সংক্ষিপ্ত করন" অপারেশনে একটি নেগেটিভ সংখ্যাকে ইকুয়েশনের অন্যপাশে নিয়ে তাকে পজিটিভ করা হয়। "আল মুকালাবা" শব্দটির অর্থ হচ্ছে তুলনা করা, অর্থ্যাৎ ইকুয়েশনের দুই পাশকে তুলনা করা। আরবী ভাষায় "আল জবর ওয়াল মুকাবালা" কথাটির মানে হচ্ছে "যেভাবে অ্যালজাব্রা কষতে হয়" বা "সাইন্স অব অ্যালজাব্রা"।
বইটিতে প্রথমে ছয়টি মূল ইকুয়েশনকে বিল্ডিং ব্লক হিসেবে রাখা হয়। যে কোন দ্বিঘাত সমীকরনের সমাধান কল্পে ইকুয়েশনটিকে সংক্ষেপ করে ছয়টি মূল ইকুয়েশনের যে কোন একটিতে ফেলা হয়। এখানে উল্লেখ্য আজকের দিনে ইকুয়েশনকে যেভাবে ভেরিয়েবল দিয়ে প্রকাশ করা হয়, খাওয়ারিজমী কিন্তু সেভাবে প্রকাশ করেন নি। খাওয়ারিজমীর প্রকাশ ভংগি শাব্দিক, এমন কি সংখ্যাগুলো পর্যন্ত শব্দে লেখা - "বিয়াল্লিশ" বা "চল্লিশ" এভাবে। ইকুয়েশনকে শাব্দিকভাবে প্রকাশের জন্য তিনি যেসব টার্ম বেছে নেন, তা হল "স্কয়ার" (x**2), "রুট" (x) ও "সংখ্যা" (৪২)। তার দেয়া ছয়টি মূল ইকুয়েশনকে আজকের এলজাব্রায় প্রচলিত সিম্বলের মাধ্যমে নিম্নোক্ত উপায়ে লেখা যায়:
স্কয়ার যখন রুটের সমান: ax**2 = bx
স্কয়ার যখন সংখ্যার সমান: ax**2 = c
রুট যখন সংখ্যার সমান: bx = c
স্কয়ার এবং রুট যখন সংখ্যার সমান: ax**2 + bx = c
স্কয়ার এবং সংখ্যা যখন রুটের সমান: ax**2 + c = bx
রুট ও সংখ্যা যখন স্কয়ারের সমান: bx + c = ax**2
যে কোন ইকুয়েশনকে সরলীকরন করার পর এই ছয়টির একটিতে তিনি ফেলেন। তারপর বিভিন্ন জিওমেট্রিক ও এলজাব্রিক উপায়ে ইকুয়েশনের সমাধানে পৌছেন।
আল খাওয়ারিজমীর উদাহরন দেন: x**2 = 40x − 4x**2 কে পরিবর্তন করা যায় 5x**2 = 40x. এই অপারেশনটির পুন: পুন: প্রয়োগ দ্বারা ইকুয়েশন থেকে নেগেটিভ টার্মকে বিদায় করে দেয়া যায়। অন্যদিকে "আল মুকাবালা" বা "ব্যালেন্স" অপারেশন হচ্ছে ইকুয়েশনের দুই পাশ থেকে একই রাশি বিয়োগ দেয়া। যার ফলে, x**2 + 5 = 40x + 4x**2 হয়ে যায় is 5 = 40x + 3x**2। এরকম পুন পুন অপারেশনের মাধ্যমে স্কয়ার, রুট কিংবা সংখ্যা একটি ইকুয়েশনে মাত্র একবার করে আসে। ফলে উপরে উল্লিখিত ছয়টি সমাধান যোগ্য সমীকরনের একটিতে ফেলা সম্ভব হয়ে থাকে।
এই বইয়ের পরবর্তী অংশে কিছু বাস্তব উদাহরনের সমাধান দেয়া হয়েছে উপরের নিয়ম নীতিকে অনুসরন করে। এছাড়া ক্ষেত্র ও আয়তনের কিছু সমস্যার সমাধান রয়েছে। শেষ অংশে রয়েছে মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের কিছু উদাহরন ও তা সম্পর্কিত বাস্তব সমস্যার সমাধান।
খাওয়ারিজমীর প্রসংগে বিভিন্ন স্কলারদের মূল্যায়ন:
জে ও কনর এবং রবার্টসন ম্যাক টিউটর হিস্টরী অব ম্যাথমেটিক্স এর আর্কাইভে লেখেন:
"আল খাওয়ারিজমীর নূতন আইডিয়া গ্রীক গনিতের থেকে এক বৈপ্লবিক উত্তরন, কারন গ্রীক গনিত শাস্ত্র মূলত জিওমেট্রি বেসড। ......এলজাব্রা গনিত শাস্ত্রকে একটি নূতন উন্নত পথ দেখিয়েছে যা কনসেপ্টের দিক দিয়ে অতীতের চেয়ে অনেক বিস্তৃত, এবং যা ভবিষ্যৎ উন্নয়নের কারিগড়। "
ফিলিপ হাইটির ভাষ্য:
"তিনি অন্য যে কোন মধ্য যুগীয় লেখকের চেয়ে গনিতের চিন্তাধারার উপর অনেক বেশী অবদান রাখেন।"
ইতিহাসবেত্তা জর্জ সারটুন নবম শতকের প্রথম অর্ধেককে নির্দিষ্ট করে দেন খাওয়ারিজমীর জন্যে।
একজন বিশ্বাসী হিসেবে খাওয়ারিজমী:
তিনি তার অবদানের জন্য খলিফা মামুনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে লিখেছিলেন:
"আমিরুল মুমিনিন আল মামুনকে আল্লাহ বিজ্ঞানের প্রতি আসক্তি উপহার দিয়ে ধন্য করেছেন। যে বন্ধুত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা তিনি জ্ঞানীদের প্রতি প্রদর্শন করেন, যে দ্রুততার সাথে তিনি কাঠিন্যকে সহজ করতে এবং দুর্বোধ্যকে বোধগম্য করতে সাহায্য করে থাকেন - তাই আমাকে আল জবর ও আল মুকাবালা রচনা করতে অনুপ্রানিত করেছে, যা কি না সংখ্যা শাস্ত্রের জন্য সবচেয়ে সহজ এবং দরকারী। "
- আল খাওয়ারিজমী।
(That fondness for science, by which God has distinguished the IMAN AL MAMUN, the commander of the faithful, that affability and condescension which God shows to the learned, that promptitude with which he protects and supports them in the elucidation of obscurities and in the removal of difficulties, has encouraged me to compose a short work on calculating by al-Jabr [algebra] and al-Muqabala, confining it to what is easiest and most useful in arithmetic).
একজন একনিষ্ঠ মুসলিমের মতই আল খাওয়ারিজমীও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার অবদানকে স্রষ্টার উপহার বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। খাওয়ারিজমীর বইয়ের মুখবন্ধ শুরু হয়েছে লেখকের পরিচয় ও বৃত্তান্ত দিয়ে -
মোহাম্মদ বিন মুসা, রাদি আল্লাহু আনহু ওয়া আথাবাহু ওয়া রাহেমা, অর্থ্যাৎ আল্লাহ মোহাম্মদ বিন মুসার উপর সন্তুষ্ট থাকুন এবং রহম করুন।
তিনি তার অবদানের জন্য আল্লাহর যেভাবে সন্তুষ্টি কামনা করেছেন, আমরাও উনার জন্য অনুরূপ প্রার্থনা করছি। আল্লাহ যেন তার আত্মার মাগফেরাত দেন এবং তাকে জান্নাতে দাখিল করেন।
===========================================
রেফারেন্স সাইট:
http://en.wikipedia.org/wiki/The_Compen … _Balancing
http://en.wikipedia.org/wiki/Muhammad_i … -Khwārizmī
http://knowledgerush.com/kr/encyclopedia/Al-Khawarizmi/
http://www.iidl.net/pdf/science/53359697.pdf
http://www.math10.com/en/maths-history/ … ardo2.html
http://www.muslimheritage.com/topics/de … icleID=317
http://books.google.com/books?id=8uEFaP … mp;f=false
পুনশ্চ: লেখাটির জন্য রেফারেন্স হিসেবে সবচেয়ে ডিটেইল বইটি হল: "গ্রেট মুনলিম ম্যাথমেটিশিয়ানস"। লিখেছেন "মোহাইনি মোহামেদ"। তিনি মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির এসোসিয়েট অধ্যাপিকা। http://books.google.com/books?id=8uEFaP … mp;f=false
যারা মালয়েশিয়া থাকেন, তারা কি উনার নাম শুনেছেন?
Last edited by ummu (গতকাল 22:01:40)
Friday, August 21, 2009
Friday, August 7, 2009
চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী ইবনে সিনা
স্বল্প কথায় পরিচিতি:
পশ্চিমে তিনি "দ্য প্রিন্স অব ফিজিশিয়ানস" নামে পরিচিত। তার গ্রন্থ "আল কানুন ফিল থিব" (কানুন অব মেডিসিন) চিকিৎসা শাস্ত্রের মূল অপ্রতিদ্বন্দ্বী পাঠ্য পুস্তক হিসেবে গন্য হত প্রায় পাচ শতক ধরে । যদিও তিনি ফার্মাকোলজি ও ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসের প্রভূত উন্নয়ন করেন, তার মূল অবদান ছিল মেডিসিন শাস্ত্রে। তিনি হলিস্টিক মেডিসিনের প্রনেতা - যেখানে একই সংগে শারীরীক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক যোগসূত্রকে বিবেচনায় রেখে রুগীর চিকিৎসা করা হয়। তিনিই প্রথম মানব চক্ষুর সঠিক এনাটমি করেন। যক্ষা রোগ নিয়ে তিনি অভিমত দেন যে যক্ষা একটি ছোয়াচে রোগ। যা তার পরের পশ্চিমা চিকিৎসকবৃন্দ প্রত্যাখ্যান করেন এবং যা আরো পরে সঠিক বলে প্রমানিত হয়। তিনিই প্রথম মেনিনজাইটিসকে ব্যাখা করেন। প্রকৃত পক্ষে তিনিই আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক।
এই "তিনি" আর কেউ নন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী ইবনে সিনা। যার অসংখ্য অবদানের গুটি কয়েক অবদানের কথা উপরের প্যারাতে আমি উল্লেখ করেছি। যার জীবন কিংবা কর্মের কোন শেষ নেই, তার সমস্ত অবদান উল্লেখ করার অসম্ভব কোন ইচ্ছেও আমার নেই। তার শুভাকাংখীরা তাকে জ্ঞানার্জন ও গবেষনার প্রানান্ত পরিশ্রম ত্যাগ করে জীবনকে সহজ ভাবে নেবার উপদেশ দিতেন, যা তিনি হেলায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বলা হয়, তার মাইল স্টোন পুস্তক "কানুন" লিওনার্ডো দ্য ভিনসিকেও প্রভাবিত করেছিল। "কানুন" বারশ শতকে ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত হয়ে প্রায় সতেরশ শতক পর্যন্ত পৃথিবীতে চিকিৎসা শাস্ত্রের টেক্স্ট বুক হিসেবে গন্য হত। একজন প্রথিতযশা পশ্চিমা ডক্টর "কানুন"কে "মেডিকেল বাইবেল" বলে ঘোষনা করেন। বুখারায় তার জন্ম স্থানে যে মিউজিয়াম রয়েছে তাতে তার নিবন্ধ, সার্জিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট এবং রুগীদের চিকিৎসারত অবস্থায় ছবি - এই সবই স্থান পেয়েছে। তিনি যে শুধু চিকিৎসা শাস্ত্রেই অবদান রেখেছেন তা নয়, বরং এস্ট্রোনমি সহ আরো অনেক শাখায় তার গুরুত্ব বহ অবদান রয়েছে। তিনি মোমেন্টামকে ওজন ও বেগের গুনফলের সমানুপাতিক বলে অভিমত দেন। তিনি আরো অভিমত দেন যে, হাজারো চেষ্টা করলেও সীসা বা তামা থেকে সোনা বানানো যাবে না, যা তার সময়ের অনেক বিজ্ঞানী নিরন্তর চেষ্টা করেছিলেন। তিনি শুক্র গ্রহকে পৃথিবীর চেয়ে সূর্যের অধিকতর নিকটে অবস্থিত বলে নির্নয় করেন। তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ চাদের একটি ফাটলের নাম তার নামে করা হয়েছে।
জীবদ্দশাতেই একজন সফল চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইবনে সিনা জার্জানের রাজপুত্রের চিকিৎসা করে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। এই জার্জানেই তিনি তার বিখ্যাত বই "কানুন" রচনা করেন। জার্জানের রাজপুত্র অনেক দিন ধরে অসুস্থতায় ছিলেন শয্যাশায়ী। স্থানীয় চিকিৎসকরা কিছুতেই তার অসুস্থতা ধরতে পারছিলেন না, তারা রীতিমত হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। অবশেষে ইবনে সিনার সাহায্য নেন। ইবনে সিনা খেয়াল করলেন রাজপুত্রের সামনে তার প্রেমিকার নাম উচ্চারন করতে পালসের গতি বেড়ে যায়। ইবনে সিনা সহজ ছোট্ট সমাধান দিলেন, "যুগলদের মিলিয়ে দাও।"
মেটাফিজিক্সের প্রতি তার গুরুত্ব যেভাবে এল:
প্রথমে ইবনে সিনা মেটাফিজিক্সকে স্পর্শের বাইরে বলে গুরুত্ব দেন নি। এর অধ্যয়নকে সময় নষ্ট বলে মনে করতেন। কিন্তু একটি বিকেল তাকে বদলে দিল। সে বিকেলে বইয়ের বাজারে এক বিক্রেতা তাকে অনেক কষ্টে তিন দিরহামের বিনিময়ে আরেকজন বিতর্কিত মুসলিম দার্শনিক ফারাবীর "অন দ্য অবজেক্টস অব মেটা ফিজিক্স" বইটিকে কিনতে প্ররোচিত করেন। বিক্রেতা খুব অর্থের দরকার হয়ে পড়েছিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি বইটি কেনেন। বইটি পড়ার পরে সবকিছু বদলে যায়। ফেলে আসা এরিস্টটলের মেটা ফিজিক্স দর্শনকে আবার গুরুত্ববহ মনে করেন এবং পরদিন এই কৃতজ্ঞতায় গরীবদের অর্থদান করেন। তিনি বলেন, "আমি এরিস্টটলের মেটা ফিজিক্স মোট চল্লিশ বার অধ্যয়ন করে তাকে হৃদয়ে আয়ত্ত্ব করি। তা সত্ত্বেও আমার বোঝায় ঘাটতি থেকে যায়। শেষে ফারাবীর এই বই পড়েই আমি এরিস্টটলের মেটা ফিজিক্স বুঝতে পারি।" তার দর্শনে মেটা ফিজিক্স একটি গুরুত্বপূর্ন স্থান দখল করে রয়েছে। তার অন্যতম মাইলস্টোন পুস্তক শিফাকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়: লজিক, ফিজিক্স, মেটা ফিজিক্স, ম্যাথমেটিক্স। এই মেটা ফিজিক্সের উপরে গবেষনা পরবর্তীতে তার বিরোধীদের প্রধান অস্ত্রে পরিনত হয়।
যেভাবে এল কাফের ফতোয়া:
মাত্র দশ বছর বয়েসে অসাধারন মেধাবী ইবনে সিনা হাফিজ হন। আর সতের বছর বয়েসে হন চিকিৎসক। ইবনে নিসা, ল্যাটিন ভাষায় যাকে বলা হয় "আভিসেনা", অভিযুক্ত হন মুরতাদ এবং কাফের হিসেবে। তার বিরুদ্ধে এই ফতোয়া ইস্যু করেন ইমাম গাজ্জালী।
কিন্তু কেন? ইবনে নিসাই তো প্রথম তার দর্শনে আল্লাহর অস্তিত্বকে প্রমান করার প্রয়াস নেন যা রয়েছে "শিফা"র মেটা ফিজিক্স অধ্যায়ে। তিনি এরিস্টটলের অস্তিত্ব ও করন মতবাদকে ব্যাখা করতে গিয়ে বলেন, কাজ এবং ফলাফল একই সাথে অবস্থান করে। তিনি প্রকৃতির সব কিছুকে একটি চেইনের মাধ্যমে প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, "এই চেইন অসীম হতে পারেনা, অবশ্যই সসীম যার প্রথমে রয়েছেন স্রষ্টা যিনি পরমূখাপেক্ষী নন। যা এই চেইনের একমাত্র ব্যতিক্রম।"
ইবনে সিনার প্রতি ইমাম গাজ্জালীর এই বিরোধীতার মূলে রয়েছে মেটা ফিজিক্সে ইবনে সিনার নিজস্ব দর্শন। তার বিরুদ্ধে কাফের ফতোয়া দেয়া হয় নিম্নোক্ত তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। প্রথমত: ইবনে সিনা তার দর্শনে বিশ্বকে চিরজীবী দাবী করেন যার কোন শুরু নেই। যেখানে মুসলিমরা বিশ্বাস করেন আল্লাহ শূন্য থেকে এই পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন। দ্বিতীয়ত: তিনি বলেন, আল্লাহ সৃষ্টি এবং ধ্বংস সম্পর্কে সাধারন ভাবে জানেন, কিন্তু পুংখানুপুঙ্খ ভাবে নয়। যেখানে মুসলিমরা বিশ্বাস করে থাকেন, আল্লাহ আক্ষরিক অর্থেই প্রতিটি বিষয় অবগত। তৃতীয়ত, তিনি শারীরীক পুনরুথ্থান নয়, বরং আত্মিক পুনরুথ্থানের উপর জোড় দেন। মূলত এই তিনটি কারনে ইমাম গাজালী ইবনে সিনাকে কাফের সাব্যস্ত করা বাধ্যতামূলক বলে দাবী করেন।
এখন দেখা যাক, এই আপাত বিতর্কিত্ ইস্যু গুলো নিয়ে ইবনে সিনা আসলে কি বলেছিলেন।
ইবনে সিনা এটা বিশ্বাস করতেন যে, এই বিশ্ব চিরজীবী বা আদি অন্ত বিহীন। তবে এটাও বিশ্বাস করতেন যে, বিশ্ব একটি সৃষ্ট বস্তু। তিনি ব্যাখা দেন, সৃষ্ট হবার অর্থ এই নয় যে সময়ের প্রেক্ষিতে তার কোন শুরু আছে। তিনি আরো বলেন, বিশ্বের অস্তিত্বের পেছনে কার্যকরন ও প্রয়োজন বিদ্যমান। আল্লাহ এই বিশ্বকে হতে দিয়েছেন, যার শুরু থাকতেও পারে কিংবা নাও থাকতে পারে। তবে শেষ নেই। ইমাম গাজালী চ্যালেন্জ্ঞ দিয়ে বলেন, আল্লাহ যদি একমাত্র স্বাধীন অমূখাপেক্ষী সত্ত্বা হন তবে বিশ্বকে তার পরেই সৃষ্ট হতে হবে, তা অস্তিত্ব ও সময় - দুটোরই মানদন্ডে। সুতরাং তা অনাদি অনন্ত হতে পারে না। এই দর্শনকে কুফরী বলে আখ্যায়িত করেছেন ইমাম গাজালী।
এবারে আসা যাক আল্লাহর জ্ঞানের পরিধি নিয়ে ইবনে সিনা কি বলেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহ সমস্ত খুটিনাটি বিষয় সম্পর্কে অবহিত, তবে এই জানাটা সামগ্রিক। সময়ের ভিত্তিতে তার জ্ঞানের কোন পরিবর্তন হয় না। ফলে যখন কোন ইভেন্ট সত্যি সত্যি সংঘটিত হয়, তখন তা তিনি নূতন করে জানতে পারেন না, কারন তার জ্ঞান সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয় না। ইবনে সিনা আল্লাহর "একচ্ছত্র (এবসোলিউট) জ্ঞান"কে "সময়ের সাথে অপরিবর্তনশীল" বলে ব্যাখা করেন।
("When this particular event actually occurs in time, God, not being subject to temporal change, cannot know it. But He also need not know it in this manner for He knows it already".) ইবনে সিনার স্রষ্টা সম্পর্কিত দর্শন সাদামাটা ভাষায় (আমি যা বুঝলাম) হচ্ছে : প্রকৃতির প্রতিটি নিয়ম স্রষ্টার অবগত এবং প্রকৃতির প্রতিটি বস্তু কার্যকরন, ফলাফল ও তাদের সম্পর্কের দ্বারা পরিচালিত। যেহেতু এসব বস্তু নিয়মের বাইরে নয়, এবং সেই নিয়মের খুটিনাটি স্রষ্টার অবগত, তাই এসব বস্তুর খুটিনাটি সম্পর্কে স্রষ্টার ধারনা সামগ্রিক।
সত্যি বলতে কি তার এই ডকট্রিনে আমি কোন কুফরি খুজে পাই নি। যদিও এই ডকট্রিনকেও কুফরী লেবেল সাটা হয়েছে। ইবনে সিনা "স্রষ্টার খুটিনাটি জ্ঞান" কে ব্যাখা করেছেন তার নিজের দর্শন দিয়ে। এই খুটিনাটি জ্ঞানকে তিনি অস্বীকার করেন নি মোটেও। তিনি যুক্তি এবং কার্যকরনকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, সমস্ত ঘটনা প্রবাহ নিয়মের ছকে বাধা বলেই ঘটছে। এই নিয়ম স্রষ্টার তৈরী যার ফলে কোন ঘটনা ঘটলে তা আলাদা ভাবে স্রষ্টার জানার কিছু নেই কারন তা তো নিয়মের প্রেক্ষিতেই ঘটেছে। সেন্স-পারসেপশন, যা ঘটনাপ্রবাহের উপর নির্ভর করে, তা স্রষ্টার ক্ষেত্রে খাটেনা কারন তার জ্ঞান সময়ের উর্ধ্বে এবং সময়ের সাথে অপরিবর্তনশীল। আমি যা বুঝলাম তা হল পুরো বিশ্ব এবং তার ঘটনাপ্রবাহকে একটি if-else সমৃদ্ধ প্রোগ্রাম দিয়ে প্রকাশ করা যায়, যার ইনপুট আউটপুট সহ পুরো প্রোগ্রাম স্রষ্টার জ্ঞানের সীমায়। তাই খুটিনাটি ভাবে কখন কোন পথ ধরে প্রোগ্রাম এগুচ্ছে তা তো স্রষ্টার জানার কোন প্রয়োজন নেই। যা হোক, এই ডকট্রিন তার বিরুদ্ধে ফতোয়ার ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
তাকে সবচাইতে বেশী সমালোচনা সহ্য করতে হয় যে কারনে তা হল শারীরীক পুনরুথ্থান বিষয়ে তার অবস্থান। দাবী করা হয় মৃত্যু পরবর্তী শারীরীক পুনরুথ্থানকে ইবনে সিনা অস্বীকার করেছেন। উল্লেখ্য শারীরীক পুনরুথ্থানে বিশ্বাস পোষন ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের একটি। নীচের আয়াতগুলোতে সমর্থন পাওয়া যাবে:
"মানুষ কি মনে করে যে আমরা কখনো তার হাড়গোড় একত্রিত করব না। হ্যা, আমরা তার আংগুলগুলো পর্যন্ত পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম।" (ক্কিয়ামাহ: ৩-৪)।
"তারা বলেঃ যখন আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাব, তখনও কি নতুন করে সৃজিত হয়ে উত্থিত হব? বলুনঃ তোমরা পাথর হয়ে যাও কিংবা লোহা। অথবা এমন কোন বস্তু, যা তোমাদের ধারণায় খুবই কঠিন; তথাপি তারা বলবেঃ আমাদের কে পুর্নবার কে সৃষ্টি করবে। বলুনঃ যিনি তোমাদেরকে প্রথমবার সৃজন করেছেন। অতঃপর তারা আপনার সামনে মাথা নাড়বে এবং বলবেঃ এটা কবে হবে? বলুনঃ হবে, সম্ভবতঃ শ্রীঘ্রই।" [বনী ইসরাঈল/ইসরাঃ ৪৯-৫১]
শারীরীক পুনরুথ্থানকে অস্বীকার করার জন্য ইমাম গাজ্জালী ও আরো অনেক স্কলার ইবনে সিনাকে কাফের সাব্যস্ত করা বাধ্যতামূলক বলে দাবী করেছিলেন। মূলত এই মতবাদের ভিত্তিতে ইবনে সিনার উপর কুফরী আরোপ করা হয়। এখন প্রশ্ন ইবনে সিনা কি সত্যিই শারীরীক পুনরুথ্থানকে অস্বীকার করেছিলেন? উল্লেখ্য ইবনে সিনা নিজেও বলেছেন মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে ইসলামের আলোতেই ব্যাখা করতে হবে, এছাড়া আর কোন যুক্তি গ্রাহ্য ব্যাখা নেই। ইবনে সিনা আত্মিক পুনরুথ্থানের পক্ষে নীচের আয়াতগুলো দেন:
"হে প্রশান্ত মন।
তুমি তোমার পালন কর্তার দিকে ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে।"
(ফজর : ২৭-২৮)
ফেরেশতা ও রূহ আল্লাহর দিকে ঊর্ধ্বগামী হয় (মাআরিজ : ৪)
পরবর্তী কালে যখন ইবনে সিনার দর্শনকে আরো বিশ্লেষন করা হয়, তখন দেখা যায় তিনি প্রকৃত পক্ষে শারীরীক পুনরুথ্থানকে পুরো অস্বীকার করেন নি। তিনি সুরা ওয়াকিয়াতে যে তিনটি দলের কথা বলা হয়েছে (আর তোমরা হয়ে পড়বে তিনটি শ্রেনীতে (ওয়াক্কিয়াহ : ৭)), তার তৃতীয় দলটিকে শুধু মাত্র শারীরীক পুনরুথ্থান করা হবে বলে দাবী করেছেন। বাকী দুই দল আত্মিক ভাবেই স্বর্গ লাভ করবে। তৃতীয় দলের শারীরীক পুনরুথ্থান হবে শাস্তির জন্য। সুতরাং ইবনে সিনা শারীরীক পুনরুথ্থানকে একটি বিশেষ দলের জন্য নির্ধারন করেছেন। যার ফলে ইবনে সিনা শারীরীক পুনরুথ্থানকে সম্পূর্ন অস্বীকার করেছেন - বিরোধীদের এই দাবী দুর্বল হয়ে যায়।
এখানে উল্লেখ্য ইসলামের ইতিহাসে যুক্তি এবং লজিককে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়ার সিলসিলা ইবনে সিনাই যে প্রথম শুরু করেন - তা নয়। তার আগে মুতাজিলা গোষ্ঠীও যুক্তিকে আশ্রয় করে ইসলামের অনেক বিভ্রান্তিকর ব্যাখা দেয়। অথচ তাদের প্রতি কেউ কাফের ফতোয়া ইস্যু করে নি। আমার স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা না করে থাকলে হাদীসকে শরিয়ার উৎস হিসেবে প্রথম অস্বীকার করে এই মুতাজিলা গোষ্ঠী। কারন তারা যুক্তি দিয়ে ইসলামের অনেক মৌলিক আকিদা ব্যাখা করতে চাইত, যা অনেক সময় হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হত। ইবনে সিনার দর্শনেও এই মুতাজিলা গোষ্ঠীর প্রভাব কিছুটা দেখা যায়।
ইবনে সিনা আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ ছিলেন। তিনি নিজেকে জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও একনিষ্ঠ মুসলিম বলে দাবী করতেন। তার প্রথম দুইটি দাবীর সাথে বিশ্ব একমত, যদিও তৃতীয় দাবীটি সর্বজন স্বীকৃত হয় নি। তবে পরবর্তীতে অনেকেই দাবী করেছেন কাফের ফতোয়াটা ইবনে সিনার জন্য ছিল অতিরিক্ত কঠোর একটি ফতোয়া।
কাফের ফতোয়াকে অস্বীকার করে ইবনে সিনার কবিতাটা তুলে দিলাম:
"আমার মত কাউকে ব্লাসফেমীর দায়ে অভিযুক্ত করা সহজ কিংবা সহজলভ্য নয়
আমার চেয়ে দৃঢ় বিশ্বাস আর নেই
আমার মত কেউ যদি অধার্মিক হয়ে থাকে
তবে পৃথিবীতে আর কোন মুসলিম নেই।"
পশ্চিমে তিনি "দ্য প্রিন্স অব ফিজিশিয়ানস" নামে পরিচিত। তার গ্রন্থ "আল কানুন ফিল থিব" (কানুন অব মেডিসিন) চিকিৎসা শাস্ত্রের মূল অপ্রতিদ্বন্দ্বী পাঠ্য পুস্তক হিসেবে গন্য হত প্রায় পাচ শতক ধরে । যদিও তিনি ফার্মাকোলজি ও ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসের প্রভূত উন্নয়ন করেন, তার মূল অবদান ছিল মেডিসিন শাস্ত্রে। তিনি হলিস্টিক মেডিসিনের প্রনেতা - যেখানে একই সংগে শারীরীক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক যোগসূত্রকে বিবেচনায় রেখে রুগীর চিকিৎসা করা হয়। তিনিই প্রথম মানব চক্ষুর সঠিক এনাটমি করেন। যক্ষা রোগ নিয়ে তিনি অভিমত দেন যে যক্ষা একটি ছোয়াচে রোগ। যা তার পরের পশ্চিমা চিকিৎসকবৃন্দ প্রত্যাখ্যান করেন এবং যা আরো পরে সঠিক বলে প্রমানিত হয়। তিনিই প্রথম মেনিনজাইটিসকে ব্যাখা করেন। প্রকৃত পক্ষে তিনিই আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক।
এই "তিনি" আর কেউ নন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী ইবনে সিনা। যার অসংখ্য অবদানের গুটি কয়েক অবদানের কথা উপরের প্যারাতে আমি উল্লেখ করেছি। যার জীবন কিংবা কর্মের কোন শেষ নেই, তার সমস্ত অবদান উল্লেখ করার অসম্ভব কোন ইচ্ছেও আমার নেই। তার শুভাকাংখীরা তাকে জ্ঞানার্জন ও গবেষনার প্রানান্ত পরিশ্রম ত্যাগ করে জীবনকে সহজ ভাবে নেবার উপদেশ দিতেন, যা তিনি হেলায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বলা হয়, তার মাইল স্টোন পুস্তক "কানুন" লিওনার্ডো দ্য ভিনসিকেও প্রভাবিত করেছিল। "কানুন" বারশ শতকে ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত হয়ে প্রায় সতেরশ শতক পর্যন্ত পৃথিবীতে চিকিৎসা শাস্ত্রের টেক্স্ট বুক হিসেবে গন্য হত। একজন প্রথিতযশা পশ্চিমা ডক্টর "কানুন"কে "মেডিকেল বাইবেল" বলে ঘোষনা করেন। বুখারায় তার জন্ম স্থানে যে মিউজিয়াম রয়েছে তাতে তার নিবন্ধ, সার্জিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট এবং রুগীদের চিকিৎসারত অবস্থায় ছবি - এই সবই স্থান পেয়েছে। তিনি যে শুধু চিকিৎসা শাস্ত্রেই অবদান রেখেছেন তা নয়, বরং এস্ট্রোনমি সহ আরো অনেক শাখায় তার গুরুত্ব বহ অবদান রয়েছে। তিনি মোমেন্টামকে ওজন ও বেগের গুনফলের সমানুপাতিক বলে অভিমত দেন। তিনি আরো অভিমত দেন যে, হাজারো চেষ্টা করলেও সীসা বা তামা থেকে সোনা বানানো যাবে না, যা তার সময়ের অনেক বিজ্ঞানী নিরন্তর চেষ্টা করেছিলেন। তিনি শুক্র গ্রহকে পৃথিবীর চেয়ে সূর্যের অধিকতর নিকটে অবস্থিত বলে নির্নয় করেন। তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ চাদের একটি ফাটলের নাম তার নামে করা হয়েছে।
জীবদ্দশাতেই একজন সফল চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইবনে সিনা জার্জানের রাজপুত্রের চিকিৎসা করে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। এই জার্জানেই তিনি তার বিখ্যাত বই "কানুন" রচনা করেন। জার্জানের রাজপুত্র অনেক দিন ধরে অসুস্থতায় ছিলেন শয্যাশায়ী। স্থানীয় চিকিৎসকরা কিছুতেই তার অসুস্থতা ধরতে পারছিলেন না, তারা রীতিমত হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। অবশেষে ইবনে সিনার সাহায্য নেন। ইবনে সিনা খেয়াল করলেন রাজপুত্রের সামনে তার প্রেমিকার নাম উচ্চারন করতে পালসের গতি বেড়ে যায়। ইবনে সিনা সহজ ছোট্ট সমাধান দিলেন, "যুগলদের মিলিয়ে দাও।"
মেটাফিজিক্সের প্রতি তার গুরুত্ব যেভাবে এল:
প্রথমে ইবনে সিনা মেটাফিজিক্সকে স্পর্শের বাইরে বলে গুরুত্ব দেন নি। এর অধ্যয়নকে সময় নষ্ট বলে মনে করতেন। কিন্তু একটি বিকেল তাকে বদলে দিল। সে বিকেলে বইয়ের বাজারে এক বিক্রেতা তাকে অনেক কষ্টে তিন দিরহামের বিনিময়ে আরেকজন বিতর্কিত মুসলিম দার্শনিক ফারাবীর "অন দ্য অবজেক্টস অব মেটা ফিজিক্স" বইটিকে কিনতে প্ররোচিত করেন। বিক্রেতা খুব অর্থের দরকার হয়ে পড়েছিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি বইটি কেনেন। বইটি পড়ার পরে সবকিছু বদলে যায়। ফেলে আসা এরিস্টটলের মেটা ফিজিক্স দর্শনকে আবার গুরুত্ববহ মনে করেন এবং পরদিন এই কৃতজ্ঞতায় গরীবদের অর্থদান করেন। তিনি বলেন, "আমি এরিস্টটলের মেটা ফিজিক্স মোট চল্লিশ বার অধ্যয়ন করে তাকে হৃদয়ে আয়ত্ত্ব করি। তা সত্ত্বেও আমার বোঝায় ঘাটতি থেকে যায়। শেষে ফারাবীর এই বই পড়েই আমি এরিস্টটলের মেটা ফিজিক্স বুঝতে পারি।" তার দর্শনে মেটা ফিজিক্স একটি গুরুত্বপূর্ন স্থান দখল করে রয়েছে। তার অন্যতম মাইলস্টোন পুস্তক শিফাকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়: লজিক, ফিজিক্স, মেটা ফিজিক্স, ম্যাথমেটিক্স। এই মেটা ফিজিক্সের উপরে গবেষনা পরবর্তীতে তার বিরোধীদের প্রধান অস্ত্রে পরিনত হয়।
যেভাবে এল কাফের ফতোয়া:
মাত্র দশ বছর বয়েসে অসাধারন মেধাবী ইবনে সিনা হাফিজ হন। আর সতের বছর বয়েসে হন চিকিৎসক। ইবনে নিসা, ল্যাটিন ভাষায় যাকে বলা হয় "আভিসেনা", অভিযুক্ত হন মুরতাদ এবং কাফের হিসেবে। তার বিরুদ্ধে এই ফতোয়া ইস্যু করেন ইমাম গাজ্জালী।
কিন্তু কেন? ইবনে নিসাই তো প্রথম তার দর্শনে আল্লাহর অস্তিত্বকে প্রমান করার প্রয়াস নেন যা রয়েছে "শিফা"র মেটা ফিজিক্স অধ্যায়ে। তিনি এরিস্টটলের অস্তিত্ব ও করন মতবাদকে ব্যাখা করতে গিয়ে বলেন, কাজ এবং ফলাফল একই সাথে অবস্থান করে। তিনি প্রকৃতির সব কিছুকে একটি চেইনের মাধ্যমে প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, "এই চেইন অসীম হতে পারেনা, অবশ্যই সসীম যার প্রথমে রয়েছেন স্রষ্টা যিনি পরমূখাপেক্ষী নন। যা এই চেইনের একমাত্র ব্যতিক্রম।"
ইবনে সিনার প্রতি ইমাম গাজ্জালীর এই বিরোধীতার মূলে রয়েছে মেটা ফিজিক্সে ইবনে সিনার নিজস্ব দর্শন। তার বিরুদ্ধে কাফের ফতোয়া দেয়া হয় নিম্নোক্ত তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। প্রথমত: ইবনে সিনা তার দর্শনে বিশ্বকে চিরজীবী দাবী করেন যার কোন শুরু নেই। যেখানে মুসলিমরা বিশ্বাস করেন আল্লাহ শূন্য থেকে এই পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন। দ্বিতীয়ত: তিনি বলেন, আল্লাহ সৃষ্টি এবং ধ্বংস সম্পর্কে সাধারন ভাবে জানেন, কিন্তু পুংখানুপুঙ্খ ভাবে নয়। যেখানে মুসলিমরা বিশ্বাস করে থাকেন, আল্লাহ আক্ষরিক অর্থেই প্রতিটি বিষয় অবগত। তৃতীয়ত, তিনি শারীরীক পুনরুথ্থান নয়, বরং আত্মিক পুনরুথ্থানের উপর জোড় দেন। মূলত এই তিনটি কারনে ইমাম গাজালী ইবনে সিনাকে কাফের সাব্যস্ত করা বাধ্যতামূলক বলে দাবী করেন।
এখন দেখা যাক, এই আপাত বিতর্কিত্ ইস্যু গুলো নিয়ে ইবনে সিনা আসলে কি বলেছিলেন।
ইবনে সিনা এটা বিশ্বাস করতেন যে, এই বিশ্ব চিরজীবী বা আদি অন্ত বিহীন। তবে এটাও বিশ্বাস করতেন যে, বিশ্ব একটি সৃষ্ট বস্তু। তিনি ব্যাখা দেন, সৃষ্ট হবার অর্থ এই নয় যে সময়ের প্রেক্ষিতে তার কোন শুরু আছে। তিনি আরো বলেন, বিশ্বের অস্তিত্বের পেছনে কার্যকরন ও প্রয়োজন বিদ্যমান। আল্লাহ এই বিশ্বকে হতে দিয়েছেন, যার শুরু থাকতেও পারে কিংবা নাও থাকতে পারে। তবে শেষ নেই। ইমাম গাজালী চ্যালেন্জ্ঞ দিয়ে বলেন, আল্লাহ যদি একমাত্র স্বাধীন অমূখাপেক্ষী সত্ত্বা হন তবে বিশ্বকে তার পরেই সৃষ্ট হতে হবে, তা অস্তিত্ব ও সময় - দুটোরই মানদন্ডে। সুতরাং তা অনাদি অনন্ত হতে পারে না। এই দর্শনকে কুফরী বলে আখ্যায়িত করেছেন ইমাম গাজালী।
এবারে আসা যাক আল্লাহর জ্ঞানের পরিধি নিয়ে ইবনে সিনা কি বলেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহ সমস্ত খুটিনাটি বিষয় সম্পর্কে অবহিত, তবে এই জানাটা সামগ্রিক। সময়ের ভিত্তিতে তার জ্ঞানের কোন পরিবর্তন হয় না। ফলে যখন কোন ইভেন্ট সত্যি সত্যি সংঘটিত হয়, তখন তা তিনি নূতন করে জানতে পারেন না, কারন তার জ্ঞান সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয় না। ইবনে সিনা আল্লাহর "একচ্ছত্র (এবসোলিউট) জ্ঞান"কে "সময়ের সাথে অপরিবর্তনশীল" বলে ব্যাখা করেন।
("When this particular event actually occurs in time, God, not being subject to temporal change, cannot know it. But He also need not know it in this manner for He knows it already".) ইবনে সিনার স্রষ্টা সম্পর্কিত দর্শন সাদামাটা ভাষায় (আমি যা বুঝলাম) হচ্ছে : প্রকৃতির প্রতিটি নিয়ম স্রষ্টার অবগত এবং প্রকৃতির প্রতিটি বস্তু কার্যকরন, ফলাফল ও তাদের সম্পর্কের দ্বারা পরিচালিত। যেহেতু এসব বস্তু নিয়মের বাইরে নয়, এবং সেই নিয়মের খুটিনাটি স্রষ্টার অবগত, তাই এসব বস্তুর খুটিনাটি সম্পর্কে স্রষ্টার ধারনা সামগ্রিক।
সত্যি বলতে কি তার এই ডকট্রিনে আমি কোন কুফরি খুজে পাই নি। যদিও এই ডকট্রিনকেও কুফরী লেবেল সাটা হয়েছে। ইবনে সিনা "স্রষ্টার খুটিনাটি জ্ঞান" কে ব্যাখা করেছেন তার নিজের দর্শন দিয়ে। এই খুটিনাটি জ্ঞানকে তিনি অস্বীকার করেন নি মোটেও। তিনি যুক্তি এবং কার্যকরনকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, সমস্ত ঘটনা প্রবাহ নিয়মের ছকে বাধা বলেই ঘটছে। এই নিয়ম স্রষ্টার তৈরী যার ফলে কোন ঘটনা ঘটলে তা আলাদা ভাবে স্রষ্টার জানার কিছু নেই কারন তা তো নিয়মের প্রেক্ষিতেই ঘটেছে। সেন্স-পারসেপশন, যা ঘটনাপ্রবাহের উপর নির্ভর করে, তা স্রষ্টার ক্ষেত্রে খাটেনা কারন তার জ্ঞান সময়ের উর্ধ্বে এবং সময়ের সাথে অপরিবর্তনশীল। আমি যা বুঝলাম তা হল পুরো বিশ্ব এবং তার ঘটনাপ্রবাহকে একটি if-else সমৃদ্ধ প্রোগ্রাম দিয়ে প্রকাশ করা যায়, যার ইনপুট আউটপুট সহ পুরো প্রোগ্রাম স্রষ্টার জ্ঞানের সীমায়। তাই খুটিনাটি ভাবে কখন কোন পথ ধরে প্রোগ্রাম এগুচ্ছে তা তো স্রষ্টার জানার কোন প্রয়োজন নেই। যা হোক, এই ডকট্রিন তার বিরুদ্ধে ফতোয়ার ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
তাকে সবচাইতে বেশী সমালোচনা সহ্য করতে হয় যে কারনে তা হল শারীরীক পুনরুথ্থান বিষয়ে তার অবস্থান। দাবী করা হয় মৃত্যু পরবর্তী শারীরীক পুনরুথ্থানকে ইবনে সিনা অস্বীকার করেছেন। উল্লেখ্য শারীরীক পুনরুথ্থানে বিশ্বাস পোষন ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের একটি। নীচের আয়াতগুলোতে সমর্থন পাওয়া যাবে:
"মানুষ কি মনে করে যে আমরা কখনো তার হাড়গোড় একত্রিত করব না। হ্যা, আমরা তার আংগুলগুলো পর্যন্ত পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম।" (ক্কিয়ামাহ: ৩-৪)।
"তারা বলেঃ যখন আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাব, তখনও কি নতুন করে সৃজিত হয়ে উত্থিত হব? বলুনঃ তোমরা পাথর হয়ে যাও কিংবা লোহা। অথবা এমন কোন বস্তু, যা তোমাদের ধারণায় খুবই কঠিন; তথাপি তারা বলবেঃ আমাদের কে পুর্নবার কে সৃষ্টি করবে। বলুনঃ যিনি তোমাদেরকে প্রথমবার সৃজন করেছেন। অতঃপর তারা আপনার সামনে মাথা নাড়বে এবং বলবেঃ এটা কবে হবে? বলুনঃ হবে, সম্ভবতঃ শ্রীঘ্রই।" [বনী ইসরাঈল/ইসরাঃ ৪৯-৫১]
শারীরীক পুনরুথ্থানকে অস্বীকার করার জন্য ইমাম গাজ্জালী ও আরো অনেক স্কলার ইবনে সিনাকে কাফের সাব্যস্ত করা বাধ্যতামূলক বলে দাবী করেছিলেন। মূলত এই মতবাদের ভিত্তিতে ইবনে সিনার উপর কুফরী আরোপ করা হয়। এখন প্রশ্ন ইবনে সিনা কি সত্যিই শারীরীক পুনরুথ্থানকে অস্বীকার করেছিলেন? উল্লেখ্য ইবনে সিনা নিজেও বলেছেন মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে ইসলামের আলোতেই ব্যাখা করতে হবে, এছাড়া আর কোন যুক্তি গ্রাহ্য ব্যাখা নেই। ইবনে সিনা আত্মিক পুনরুথ্থানের পক্ষে নীচের আয়াতগুলো দেন:
"হে প্রশান্ত মন।
তুমি তোমার পালন কর্তার দিকে ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে।"
(ফজর : ২৭-২৮)
ফেরেশতা ও রূহ আল্লাহর দিকে ঊর্ধ্বগামী হয় (মাআরিজ : ৪)
পরবর্তী কালে যখন ইবনে সিনার দর্শনকে আরো বিশ্লেষন করা হয়, তখন দেখা যায় তিনি প্রকৃত পক্ষে শারীরীক পুনরুথ্থানকে পুরো অস্বীকার করেন নি। তিনি সুরা ওয়াকিয়াতে যে তিনটি দলের কথা বলা হয়েছে (আর তোমরা হয়ে পড়বে তিনটি শ্রেনীতে (ওয়াক্কিয়াহ : ৭)), তার তৃতীয় দলটিকে শুধু মাত্র শারীরীক পুনরুথ্থান করা হবে বলে দাবী করেছেন। বাকী দুই দল আত্মিক ভাবেই স্বর্গ লাভ করবে। তৃতীয় দলের শারীরীক পুনরুথ্থান হবে শাস্তির জন্য। সুতরাং ইবনে সিনা শারীরীক পুনরুথ্থানকে একটি বিশেষ দলের জন্য নির্ধারন করেছেন। যার ফলে ইবনে সিনা শারীরীক পুনরুথ্থানকে সম্পূর্ন অস্বীকার করেছেন - বিরোধীদের এই দাবী দুর্বল হয়ে যায়।
এখানে উল্লেখ্য ইসলামের ইতিহাসে যুক্তি এবং লজিককে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়ার সিলসিলা ইবনে সিনাই যে প্রথম শুরু করেন - তা নয়। তার আগে মুতাজিলা গোষ্ঠীও যুক্তিকে আশ্রয় করে ইসলামের অনেক বিভ্রান্তিকর ব্যাখা দেয়। অথচ তাদের প্রতি কেউ কাফের ফতোয়া ইস্যু করে নি। আমার স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা না করে থাকলে হাদীসকে শরিয়ার উৎস হিসেবে প্রথম অস্বীকার করে এই মুতাজিলা গোষ্ঠী। কারন তারা যুক্তি দিয়ে ইসলামের অনেক মৌলিক আকিদা ব্যাখা করতে চাইত, যা অনেক সময় হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হত। ইবনে সিনার দর্শনেও এই মুতাজিলা গোষ্ঠীর প্রভাব কিছুটা দেখা যায়।
ইবনে সিনা আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ ছিলেন। তিনি নিজেকে জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও একনিষ্ঠ মুসলিম বলে দাবী করতেন। তার প্রথম দুইটি দাবীর সাথে বিশ্ব একমত, যদিও তৃতীয় দাবীটি সর্বজন স্বীকৃত হয় নি। তবে পরবর্তীতে অনেকেই দাবী করেছেন কাফের ফতোয়াটা ইবনে সিনার জন্য ছিল অতিরিক্ত কঠোর একটি ফতোয়া।
কাফের ফতোয়াকে অস্বীকার করে ইবনে সিনার কবিতাটা তুলে দিলাম:
"আমার মত কাউকে ব্লাসফেমীর দায়ে অভিযুক্ত করা সহজ কিংবা সহজলভ্য নয়
আমার চেয়ে দৃঢ় বিশ্বাস আর নেই
আমার মত কেউ যদি অধার্মিক হয়ে থাকে
তবে পৃথিবীতে আর কোন মুসলিম নেই।"
Subscribe to:
Posts (Atom)