শিক্ষা নীতি নিয়ে বেশ আলোচনা দেখছি। বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে নূতন শিক্ষা নীতি করার তোড় জোড় চলছে। সে বিষয়ে বিভিন্ন জ্ঞানী গুনী বিভিন্ন রকম বক্তব্য রাখছেন। সামহোয়ার ব্লগও তার বাইরের কিছু নয়। তাই এখানেও এ বিষয়ে নানা পোস্ট দেখছি।
আমারও কিছু কথা বলতে ইচ্ছা করে। কম্পিউটারের সামনে বসে থাকলে বার বার ইচ্ছে করে ব্লগ সাইটে উকি দিতে। মাঝে মাঝে অন্যের পোস্টে মন্তব্য করি, তবে সবসময় সে অভিজ্ঞতা সুখকর হয় না। মানুষের সাথে মেলামেশায় আমার খুব সুনাম সমাজে নেই, ব্লগেও এটা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুই বছরের উপরে আমার এখানে বিচরন, অথচ শুভাকাংখী ব্লগার বলতে নাহিদ, সোহায়লা, কিংবা পারভেজ ভাই এর মত দুই চারজন হাতে গোনা। আমি তো কোনদিনও কারো আত্ম সম্মানে আঘাত করি না, ডেল কার্নেগীর বন্ধু বিষয়ক বই অনাগ্রহ, বিতৃষ্ণা নিয়ে পড়ি শুধুমাত্র বন্ধুবৎসল হবার জন্যে, কিন্তু তবুও আজতক বন্ধুহীন হয়েই রইলাম। যার নয়ে হয় না, নব্বইতেও সে না হবার দলেই থাকে।
শিক্ষা নীতি নিয়ে কথা বলতে এসে নিজের প্রসংগে এত গুলো কথার অবতারনার কারন একটিই। আমি বাংলাদেশের প্রস্তাবিত শিক্ষা নীতি নিয়ে খুব বেশী কিছু জানি না, অথচ এ নিয়ে পোস্ট দিতে চাই। প্রেম ভালোবাসা টাইপ পোস্ট দেবার ক্ষমতা আমার নেই, তার জন্য রোমান্টিক মননশীলতার দরকার, যা আমার কোন কালেই ছিল না। কিন্তু শিক্ষানীতির বিষয়ে জ্ঞান না থাকলেও, শিক্ষার বিষয়ে আগ্রহটুকু আছে। যার ফলে পোস্টে হয়ত এ বিষয়ে নিজের এলোমেলো ভাবনাগুলো তুলে ধরা আমার পক্ষে অসম্ভব হবে না।
প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি নিয়ে কথা বলতে আমার আগ্রহের কারন আমার নিজের শৈশব বেলার অভিজ্ঞতা। জীবনের মেটামরফোসিস বিশ্লেষন করলে দেখা যায় মানুষের সবচেয়ে ভাবনাহীন আলোকিত সময়টি হচ্ছে তার শৈশব - যে সময়টা মানুষ থাকে সবচেয়ে বেশী স্বাধীন এবং উৎফুল্ল। সে সময়টাতে তাকে শেখাতে হয় আনন্দের সাথে। একবার যদি শেখার আনন্দ থেকে বিচ্যুত হয়ে সে নিরানন্দতার সাথে জুটি বাধে, তবে সে শিক্ষার সাথে পরবর্তীতে একাত্ম হওয়া তার পক্ষে কঠিন।
প্রথমেই বলে রাখছি, আমি বিভাজনমূলক শিক্ষার সমর্থক। আমেরিকার এই বিভাজন মূলক শিক্ষা ব্যবস্থার যে ভাল দিকটি আমার কাছে ফুটে উঠেছে তা হল, এর ফলে শিশুদের শিক্ষিত হবার সুব্যবস্থা অনেক বেশী থাকে। উদাহরন স্বরূপ বলা চলে, এদের একটি স্বীকৃত শিক্ষা ব্যবস্থা হল হোম স্কুলিং। অনেক পিতামাতা পাবলিক স্কুলে সন্তানদের দিতে চান না, কিংবা দেবার অবস্থায় থাকেন না। তারা স্বচ্ছন্দে নিজেদের সন্তানদের হোম স্কুলিং করিয়ে থাকেন। পাবলিক স্কুল ফ্রী, তবে ডিসিপ্লিনের জন্য অনেকে প্রাইভেট স্কুলে অনেক টিউশন দিয়ে বাচ্চাদের পড়িয়ে থাকেন। ক্যাথলিক স্কুল কিংবা অন্যান্য ধর্মীয় স্কুল গুলোও সগৌরবে টিকে আছে তাদের পরিবেশ ও ডিসিপ্লিনের কারনে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে বিষয়টি আমার কাছে উদ্বেগজনক মনে হয়েছে, তা হল পাশের হার। এখনও পাশের হার শতকরা ৫০ ভাগের বেশী নয়। তার মানে অর্ধেকেরও বেশী ছাত্র ছাত্রী তাদের কাংখিত লক্ষ্যে পৌছুতে সক্ষম নয়।
এই বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা নীতিতে জোর দেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। এই ৫০ ভাগ ছাত্র ছাত্রী কি জন্য পিছিয়ে আছে। এদেরকে কি করে সামনে এগিয়ে আনা যায়? এরা কি কারনে শিক্ষা কারিকুলামের মূল সুরটি ধরতে ব্যর্থ? পাশ্চাত্যের উদাহরন টানা যাক। পাশ্চাত্যে শিক্ষার মান মোটামুটি উন্নত। কোন সাবজেক্টে কোন ছাত্র ছাত্রী পিছিয়ে থাকলে, স্কুল থেকে তার জন্য আলাদা টিউটরিং এর ব্যবস্থা রাখা হয়। এছাড়া তাদের টেক্সট বইগুলো সহজ ভাষায় লেখা, ছবি সমৃদ্ধ এবং সিলেবাস খুব একটা বিস্তৃত নয়। যার ফলে ছাত্র ছাত্রীদের পক্ষে একটা ন্যুনতম মান অর্জন করা খুব কঠিন হয় না। বাংলাদেশে কেন তবে তা এত কঠিন? তার কারন, শিক্ষক ছাত্রের উচু অনুপাতের ফলে ছাত্রের জন্য একজন শিক্ষকের প্রয়োজনীয় সময় প্রদানে অক্ষমতা, সিলেবাসের ব্যপকতা, টেক্স্ট বইগুলো দুর্বোধ্য ভাষা এবং সবশেষে একটি বিষয়কে সহজ ভাবে উপস্থাপনায় শিক্ষকের ব্যর্থতা। মূলত এই কারন গুলোই ছাত্র/ছাত্রীদের ব্যর্থতার জন্য দায়ী। ছাত্র ছাত্রীদের কাছে শিক্ষাকে সহজবোধ্য আর আনন্দময় করে তোলা যে কোন শিক্ষা নীতিতে সবচেয়ে বেশী অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। যার অবধারিত কনসিকুয়েন্স হচ্ছে পাশের হার বেড়ে যাওয়া। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখেছি শিক্ষা নীতি যখন আলোচিত হয়, তখন এই বিষয়টিকে খুব একটা জোর দিতে দেখা যায় না। ধরে নেয়া হয়, ফাকিবাজ হলে তার পক্ষে অকৃতকার্য হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু ফাকিবাজ হবার ছিদ্র গুলো বন্ধ করতে চাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। আমাদের ছেলেমেয়েদের সবাইকে কেন এত এত বেশী বই পড়তে হবে, আর এত বেশী জানতে হবে? দিন না, জেনারেল সিলেবাস একটু কমিয়ে। টেক্স্ট বই গুলো হোক ছবি আর ব্যখা সমৃদ্ধ। ভূগোল ক্লাশে গ্লোব রাখা হোক। তারা যা জানবে, তা সঠিক ভাবে জানবে। আর যেসব ছাত্র ছাত্রীরা এগিয়ে, তাদের জন্য অতিরিক্ত কিছু অধ্যয়ন থাকুক। যা আমেরিকাতে ম্যাগনেট প্রোগ্রামে করা হয়ে থাকে। এগোনো পেছোনো সব ছাত্র ছাত্রীকে একই সিলেবাস অনুসরন করে চলার চেয়ে, বরং পিছিয়ে থাকদের জন্য ন্যুনতম সিলেবাস আর এগিয়ে থাকাদের জন্য বিস্তৃত সিলেবাস বেশী ফলদায়ক বলে মনে করি। যার ফলে, পিছিয়ে থাকা ছাত্র ছাত্রীরা একটা ন্যুনতম মান অর্জন করে এগোতে পারবে। আর এগিয়ে থাকা ছাত্র ছাত্রীরাও তাদের কাংখিত মানের লক্ষ্যে পৌছুতে পারবে।
শিক্ষা ব্যবস্থা বিভাজনমূলক হলে তার বিষয়ে নীতিমালা অনুসরন করতে হবে। এটা খুব স্বাভাবিক যে, মাদ্রাসায় ধর্ম বিষয়ে বেশী জোর দেয়া হবে, কিন্তু সাধারন শিক্ষায় তা দেয়া হবে না। তা সত্ত্বেও কিছু বিষয়কে সবার জন্য আবশ্যিক করে দেয়া দরকার। সেগুলো হতে পারে, ল্যাংগুয়েজ আর্টস, সাইন্স, ম্যাথ, সোশাল স্টাডিজ। যেমনটি আমেরিকাতে রয়েছে। ল্যাংগুয়েজ আর্টস আবার বিভক্ত হতে পারে কয়েকটি ভাগে: স্পেলিং, গ্রামার, রিডিং, রাইটিং। আমেরিকাতে এর বাইরে ইসলামিক স্কুল গুলো কোরান, এরাবিক, ইসলামিক স্টাডিস পড়িয়ে থাকে। আর সাধারন পাবলিক স্কুলগুলো সম্ভবত আর্টস, স্প্যানিশ -এসব পড়িয়ে থাকে। বিষয়গুলো অপশনাল হওয়ায় শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈচিত্রতা চলে আসে।
বাংলাদেশে দেখলাম ফাইন আর্টসকে বাধ্যতামূলক করা হবে। এ বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। ড্রইং আর মাটির কাজ - এই দুটো সাবজেক্ট আমার প্রাইমারী স্কুলে ছিল। পাশ মার্কস জোগাড় যে কি কঠিন ছিল, তা মনে করলে আজো শিউরে উঠি। এসব ক্লাসে আমাকে কেউ কখনও ধরে ধরে শিখিয়ে দেয় নি। আমার মনে হয় না এসব বিষয় আবশ্যিক হিসেবে থাকা উচিত। যতদিন না ভালভাবে ছাত্র ছাত্রীদের শেখানোর ব্যবস্থা থাকবে, ততদিন সেলাই, মাটির কাজ কিংবা ড্রইং সাবজেক্টগুলো অতিরিক্ত হিসেবে রাখা প্রয়োজন।
মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় মূল ধারার সাবজেক্ট হিসেবে বাংলা, ইংরেজী, সাইন্স, ম্যাথ এবং সোশাল স্টাডিজ আবশ্যিক হিসেবে থাকা প্রয়োজন। সাহিত্য ও সোশাল স্টাডিজ মাদ্রাসা বোর্ডের জন্য আলাদা হতে পারে। জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা উত্তোলন কিংবা শপথ - অন্ততপক্ষে একটিকে মাদ্রাসাগুলোর বেছে নিতে হবে।
সাধারন শিক্ষায়ও ধর্ম ও কোরান শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা উচিত। তবে সাধারন শিক্ষায় আরবী থাকার কোন দরকার নেই। ক্লাস এইট পর্যন্ত আমাদের আরবী পড়তে হয়েছে, অথচ তা থেকে কিছু শিখতে পারিনি। তাই আরবী আমার কাছে অহেতুক মনে হয়। আমেরিকার সাধারন স্কুলে ধর্ম পড়ানো হয় না। বাংলাদেশের সাধারন স্কুলে ধর্ম শিক্ষা স্বাধীনতার পর থেকেই চলে আসছে। এখনো অভিভাবকরা ধর্ম শিক্ষার পক্ষে রয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ গড়তে ধর্ম শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তাহলেই কেউ আর ধর্মের নামে বিভ্রান্ত হবে না।
বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ অত্যন্ত চমৎকার, যা অন্য দেশের জন্য মডেল হতে পারে। এই পরিবেশকে উৎসাহিত করতে সোশাল স্টাডিজে বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন উৎসব যেমন, ঈদ, পুজা, পূর্নিমা সহ বিভিন্ন উৎসবের বর্ননা যোগ করা যেতে পারে, কিন্তু সরাসরি অন্য ধর্মের খুটিনাটি শেখানোটা অপ্রয়োজনীয়।
যাক, অনেক কথা বলে ফেললাম। হয়ত বা অরন্যে রোদন। কিন্তু নিজের কথ গুলো বলার আনন্দ থেকে নিজেকে ফাকি দিতে চাইলাম না।
Tuesday, November 17, 2009
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment