Wednesday, November 25, 2009

প্রাচীন রসায়নের জনক জাবির হাইয়ান ও তার অবদান এবং ইসলাম বিদ্বেষী ফেইথ ফ্রিডম

কিমিয়া থেকে কেমিস্ট্রি:

গুপ্তবিদ্যার প্রতি আগ্রহ মানুষের চিরন্তন। "আল কেমি" হচ্ছে সেই রকম গুপ্তবিদ্যা, যার দ্বারা মানুষ "এলিক্সির" নামে এমন একটি যাদুকরী বস্তু তৈরী করতে পারবে। সে এলিক্সিরের ছোয়ায় লোহা হয়ে যাবে সোনা, তামা হয়ে যাবে রূপা, আর মানুষের আয়ু যাবে বহুগুন বেড়ে!! লোহা থেকে সোনা বানানো কিংবা জীবনকে দীর্ঘায়িত করার বাসনাই ছিল আল কেমী বিদ্যার মূল উদ্দেশ্য।

"আল কেমি" শব্দটি এসেছে আরবী আল কিমিয়া থেকে। "আল" হচ্ছে "the" এর আরবী এবং "কিমিয়া" এসেছে "কেম" থেকে, যার অর্থ "কালো মাটি"। মিশরের নীল নদের তীরের মাটি কালো হওয়ায় এ নাম, কেননা "আল কেমী"র ব্যপক চর্চা মূলত হয়েছে মিশরে। তবে এ নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, গ্রীক "কায়মা" থেকেও "কেমী" শব্দটি আসতে পারে। "কেমী" শব্দের এটিমোলোজি যাই হোক না কেন, "আল কেমি"র ব্যপক চর্চা তৎকালীন মুসলিম সমাজে হবার ফলে, "আল কেমী" শব্দটির আরবীতে আত্তীকরন হয়ে যায়।

আল কেমী বহু আগে থেকে চলে আসা একটি সাবজেক্ট, পৃথিবীর মানুষ লোহা থেকে সোনা বানানোর অসম্ভব চেষ্টা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই করছে। এরিস্টটলের দর্শন অনুযায়ী, সমস্ত বস্তুই আসলে একই জাতীয় সাবস্ট্যান্স দিয়ে তৈরী - শুধু অনুপাত ভিন্ন। অনুপাতের ভিন্নতার ফলেই একটি পদার্থ হয় লোহা, আর অন্যটি হয় সোনা। আরব বিজ্ঞানী জাবেরও ছিলেন একজন আলকেমিস্ট যিনি এরিস্টটলের এই দর্শনের দ্বারা প্রভাবান্বিত ছিলেন। আর আল কেমী বিদ্যাটি কিছুটা সুপ্ত হওয়ায় জাবেরের বইগুলোও অনেকটা রূপক ভংগিতে লেখা। আল কেমির উপরে লেখা তার বই "কিতাব আল জোহরা"তে তিনি লিখেছেন,
"আল্লাহ যাদের ভালবাসেন তারা ব্যাতীত বাকীদের হতভম্ব করা এবং ভুল পথে নেয়াই এর উদ্দেশ্য। " অন্য জায়গায় জাবের লিখেছেন, "আমার "মাস্টার" আমাকে শাসাচ্ছেন, যাতে এসব বিদ্যা কোন অবিবেচকের হাতে না পড়ে। " আলকেমীর বিদ্যা গুপ্ত রাখার মানসিকতায় বইগুলো লিখেন কঠিন ভাষায় এবং সাধারনের বোধগম্যের বাইরে।

আল কেমীর চর্চা থেকেই জাবের একসময় আবিষ্কার করে ফেললেন অনেক কিছু। আবিষ্কার করেন কি করে তরলের মিশ্রন থেকে একটি তরলকে আলাদা করা যায়, যা ডিস্টিলেশন নামে পরিচিত, আবিষ্কার করেন একুয়া রেজিয়া নামে একটি মিশ্রন যা সোনাকে গলিয়ে দিতে পারে এবং উদ্ভাবন করেন অগুনতি কেমিক্যাল সাবসট্যান্স - যা মরিচা প্রতিরোধ, স্বর্নের কারুকাজ, পোশাকের ওয়াটারপ্রুফ সহ বিভিন্ন শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত হয়। আল কেমী থেকে তিনি সিস্টেমেটিক এক্সপেরিমেন্টেশনের দ্বারা শুরু করেন আরেকটি সাবজেক্ট, যা পরিচিতি পায় কেমেস্ট্রি হিসেবে। এ প্রসংগে তিনি বলেন, "কেমিস্ট্রির প্রাথমিক কর্তব্য হল, তুমি প্রাকটিক্যাল কাজ করবে এবং এক্সপেরিমেন্ট চালাবে। যারা প্রাকটিক্যাল কাজ করে না এবং এক্সপেরিমেন্ট চালায় না, তারা এ বিষয়ে কোন রকমের দক্ষতা অর্জন করতে পারে না।"

জাবের ইবনুল হাইয়ানের পরিচয় ও তার সংক্ষিপ্ত জীবনী:


৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দে খলিফা উমর ইউফ্রেটিসের পশ্চীম তীরে কুফা শহর প্রতিষ্ঠা করেন। চারিদিক থেকে ইমিগ্রান্ট এসে কুফায় বসতি শুরু করে, একসময় কুফার জনসংখ্যা ২০০০০০ ছাড়িয়ে যায়। পরবর্তীতে কুফা উমাইয়াদের প্রধান শহরে পরিনত হয়। এই কুফা শহরেই আজদী নামের এক গোত্রের একজন ছিলেন হাইয়ান, যার নেশাগ্রস্ততা শহরে বেশ পরিচিত ছিল। তিনি গোপনে উমাইয়া খলিফাদের বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত চলছিলো, তাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। ৭১২ শতকে উমাইয়া রাজবংশের জনপ্রিয়তায় এক বিশাল ধ্বস নামে। এছাড়া ব্যপক হারে অমুসলিমদের মুসলিম হওয়ার ফলে উমাইয়া রাজ্য অর্থনৈতিক মন্দার সম্মূখীন হয়। অমুসলিমদের কাছ থেকে আদায়কৃত জিজিয়া ট্যাক্সের পরিমান কমে যায়, যা রিভিনিউতে মারাত্মক ধ্বস নামায়। মুসলিমরা যাকাত দিলেও সে যাকাতের খাত নির্দিষ্ট, সর্বমোট আটটি। ফলে উমাইয়াদের পক্ষে অর্থনৈতিক ধ্বস সামলানো কঠিন হয়ে যায়।

ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আলীর নেতৃত্বে আব্বাসীয় নেতৃত্ব আসে ক্ষমতায়, যাদেরকে সক্রিয় সহযোগিতা করে শিয়া সম্প্রদায়। জাবেরের পিতা হাইয়ান, যিনি ছিলেন একজন শিয়া, এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। হাইয়ান এক পর্যায়ে উমাইয়াদের হাতে ধরা পড়ে যান এবং নিহত হন। ফলশ্রুতিতে ৭২১ খ্রীষ্টাব্দে জন্ম শিশু জাবের বড় হন পিতাকে ছাড়াই। কৈশোরে তিনি কোরান, গনিত সহ বেশ কিছু বিষয়ে পারংগমতা অর্জন করেন। আব্বাসীয় রাজবংশ অবশেষে প্রতিষ্ঠা পায়। কথিত আছে আব্বাসীয় জেনারেল আবদুল্লাহ একবার ৮০ জন উমাইয়া নেতাকে দাওয়াত করেন। উমাইয়া নেতারা যখন খেতে ব্যস্ত, তখন আবদুল্লাহ আদেশ দেন এদের হত্যা করার জন্যে। শুধু একজন জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে বেচে যান, যিনি পরে ইউফ্রেটিস পার হয়ে স্পেনে পৌছান। মোট কথা, ৭৫০ শতকের এর মধ্যেই উমাইয়াদের হঠিয়ে আব্বাসীয়রা ক্ষমতা সুদৃঢ় করে নেয়।


আব্বাসীয়রা ক্ষমতায় আসার পরে জাবির এক সময় আব্বাসীয় উজির বার্মিকীর নেক নজর লাভ করেন, যার মাধ্যমে খলিফার সাথে দেখা করতে সমর্থ হন। ইয়াহিয়া বার্মিকীর একজন অতীব সুন্দরী দাসী অসুস্থ হয়ে গেলে জাবের তাকে এলিক্সির খাইয়ে পুরো সুস্থ করে দেন (যা ছিল এক ধরনের দ্রবন)। আব্বাসীয়দের কাছে হাইয়ানের সন্তান হিসেবে তিনি স্বীকৃতি পান দুভাবে: খলিফা হারুন অর রশিদের দরবারে তিনি আল কেমিস্ট হিসেবে নিয়োগ পান এবং অন্যদিকে বিখ্যাত শিয়া আলেম জাফর ইবনে আবি তালিব তাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহন করেন। শিয়াদের কাছে আল কেমী সবসময়েই আদৃত একটি বিদ্যা ছিল। আলী (রা) বলেন, "আল কেমী হচ্ছে প্রফেসীর বোন।" খলিফার দরবারে তিনি অনেকদিন কাজ করেন। খলিফা হারুন অর রশিদ পরবর্তীতে বার্মিকীদের আচরনে মহা বিরক্ত হয়ে একজনের প্রানদন্ড ও বাকীদের বরখাস্ত করেন। তখন জাবের কুফাতে ফিরে আসেন। বার্মিকীদের সাথে সুসম্পর্ক থাকার মাশুল গুনতে হয় হাউজ এরেস্ট হয়ে। অবশেষে ৮১৫ সালে এ অবস্থাতেই তিনি মৃত্যু বরন করেন।


জাবেরের কিছু গুরুত্ববহ অবদান:

ডিস্টিলেশন হচ্ছে দুটি দ্রবনকে তাদের ভিন্ন স্ফুটনাংকের মাধ্যমে আলাদা করা। জাবির ইবনুল হাইয়ানের এই আবিষ্কার আলকেমী থেকে কেমিস্ট্রির পথে ছিল মাইলস্টোন উত্তরন। বিজ্ঞানী জাবির এক্সপেরিমেন্টেশনের উপর গুরুত্ব দেন এবং আল কেমীকে সাইন্স রূপ দিয়ে কেমিস্ট্রি হিসেবে দাড় করান। তিনি সালফিউরিক এসিড, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, নাইট্রিক এসিড, ডিস্টিলেশন, ক্রিস্টালাইজেশন, লিকুইফ্যাকশন, অক্সিডাইজেশন, ইভাপোরেশন, ফিলট্রেশন সহ বেশ কিছু কেমিক্যাল এবং তার প্রসেস ব্যখা করে যান, যা আজকের কেমিস্ট্রির ভিত্তিমূল।

বিজ্ঞানী জাবের হাইড্রোক্লোরিক এসিড এবং নাইট্রিক এসিড আবিষ্কার করে তার মিশ্রন থেকে আবার "একুয়া রেজিয়া" আবিষ্কার করেন যা সোনাকে দ্রবীভূত করে। যার ফলে সোনার বিশুদ্ধিকরন এবং আহরন সহজ হয়ে যায়। এছাড়া তিনি সাইট্রিক এসিড, এসিটিক এসিড এবং টারটারিক এসিড আবিষ্কার করেন। জাবেরের এই রসায়নের জ্ঞান বিভিন্ন শিল্প কারখানায় সফলভাবে প্রয়োগ করা হয় এবং তার ফলে অনেক ধরনের ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেস উন্নত হয়। যাদের মধ্যে রয়েছে, স্টীল প্রস্তুতকরন, মরিচা প্রতিরোধকরন, স্বর্ন খোদাইকরন, পোশাকের ডাই তৈরী এবং চামড়ার ট্যানিং। তিনি গ্লাস তৈরীতে ম্যাংগানিজ ডাই অক্সাইড ব্যবহার বিধি দেখান, যা আজকের দিনেও ব্যবহৃত হয়। তার এসব আবিষ্কার আজকের কেমিস্ট্রি এবং কেমিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং এর ভিত্তিমূল।


জাবেরিয়ান করপাস:

জাবেরের গ্রন্থের পরিমান এত বেশী যে ধারনা করা হয় একা জাবেরের পক্ষে এতগুলো বই লেখা অসম্ভব। জাবেরের পরবর্তি কালে জাবেরের নামে ইসমাইলিয়া সম্প্রদায় এসব বইয়ের কিছু অংশ লিখতে পারে বলে মনে করা হয়। জাবেরের গ্রন্থ সমগ্রকে চার ভাগে ভাগ করা যায়:

১। আত্মিক আলকেমি: এ বিষয়ে প্রায় ১১২ টি বই রয়েছে যা বার্মিকি উজিরদের উৎসর্গ করে লেখা।

২। দর্শন : ১০ টি বই রয়েছে পিথাগোরাস, সক্রেটিস, এরিস্টটল ও প্লেটোর দর্শনকে ব্যাখা করে। জাবের তার লেখায় গ্রীক ও মিশরীয় আলকেমিস্টদের প্রতি শ্রদ্ধা ব্যক্ত করেছেন।

৩। ৭০টি বই রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ের উপরে।

৪। আরো কিছু বই রয়েছে "ব্যালেন্স অব ন্যাচারের" উপরে।


কারো পক্ষে এত বই লেখা কি করে সম্ভব? তাই, ধারনা করা হয়, জাবেরের অনুসারীরা হয়তবা তার নামে কিছু বই লিখে রেখেছে। এ নিয়ে এখনো গবেষনা চলছে।

আগেই বলেছি, জাবেরের অনেক বই আল কেমির প্রথা অনুযায়ী খুব রহস্যের ভংগিতে লেখা। জাবেরের স্ক্রীপ্টের এই গুপ্ত ভাব থেকে ইংরেজীতে "gibberish" শব্দটি এসেছে। যার অর্থ "যা বোধগম্য নয়।"


জাবের প্রসংগে ফেইথ ফ্রিডমের ভন্ডামি:

ফেইথ ফ্রিডম সাইটের কথা আপনারা শুনেছেন কিনা জানিনা। ইসলামের উপর তিতা বিরক্ত হয়ে যারা ইসলাম পরিত্যাগ করেছেন, তাদের মিলন মেলা হল এই সাইট। কে ইসলাম ত্যাগ করল, এটা আমার কাছে খুব বড় কোন ইস্যু নয়। ইসলাম একই সাথে বিশ্বাস এবং আচার সমৃদ্ধ একটি ধর্ম। এই বিশ্বাসকে অস্বীকার করে কেউ ইসলাম ত্যাগ করতে চাইলে সে অধিকারটুকু তার থাকা উচিত। মানুষের বিশ্বাসের স্বাধীনতার এই বিষয়টি মুসলিমদের স্বীকার করে নেয়া উচিত। এতে ক্ষতির কিছু নেই, বিশেষত যেখানে পৃথিবীতে ইসলাম গ্রহনের হার তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশী। এছাড়া পবিত্র কোরানেও বিশ্বাসের স্বাধীনতার বিষয়টি অনেকবার এসেছে।

তবে ফেইথ ফ্রীডমের ক্ষেত্রে কথা হল: যতটা না সত্য, তার চেয়ে বেশী বিদ্বেষ দিয়ে পরিচালিত এই সাইট। এই বিদ্বেষ শুধু সাধারন ভাবে ইসলামের বিশ্বাস এবং আচারের বিরুদ্ধে নয়, বরং মুসলিমদের গৌরবময় ঐতিহ্য বিচারের ক্ষেত্রেও। আমি রসায়নবিদ জাবিরকে নিয়ে লেখার সময় গুগলে একটা সার্চ দেই। অনেক সাইটের মধ্যে ফেইথ ফ্রিডম ছিল একটি, যেখানে জাবের প্রসংগে নীচের কথাগুলো রয়েছে:

"Muslim apologists claim that Jabir Ibn Haiyan was the father of chemistry though Chemistry was practiced from ancient ages. Egyptians used distillation process in 3000 years BC and the Greeks in 1000 BC. Zosimus of Panopolis wrote "The Divine Art of Making Gold and Silver", in the 4th century. Jabir Ibn Haiyan should not be called the founder of Chemistry, which is nothing but the usual deceiving technique of Muslim apologists."


মোদ্দা কথা, জাবেরকে কেন প্রাচীন রসায়নের জনক বলা হবে, সেটাই তাদের কাছে বিষ্ময়। এটা নাকি মুসলিমদের ভন্ডামির আরেকটি পরিচয়!!!!

আমি এ বিষয়ে প্রথমে বলতে চাই যে, জনক শব্দটি কিছুটা আপেক্ষিক। জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতির বিষয়টি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়াতে কেউ হয়ত কোন আইডিয়া প্রথমে দেন, আবার কেউ বা তার উপর ব্যপক কাজ করে পৃথিবীর কাছে তা পরিচিত করেন। ফলশ্রুতিতে অনেক সময় দেখা যায়, যার কাজের মাধ্যমে পৃথিবী পরিচিত হয় একটি নূতন বিষয়ে, তাকেই "জনক" উপাধি দেয়া হয়। যার ফলে "জনক" শব্দটি নিয়ে রয়েছে ব্যপক বিতর্ক। তবে ফেইথ ফ্রিডম যে দাবীটা করেছে যে, জাবিরকে রসায়নের জনক বানানোটা মুসলিমদের আরেকটা ভন্ডামি - সেটা সম্পূর্ন অসত্য। জাবির তার অবদানের মাধ্যমেই পৃথিবীর সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হয়েছেন। উইকিপিডিয়াতে (Click This Link) তাকে প্রাচীন রসায়নের জনক বলা হয়েছে তার কাজকে মূল্যায়ন করেই। জাবেরকে রসায়নের জনক স্বীকৃতি দিয়ে এরকম শত সহস্র লেখা পাওয়া যাবে যার উপর মুসলিমদের কোন প্রভাব নেই। সুতরাং ফেইথ ফ্রিডমের এসব কথা শুধুই বিদ্বেষ প্রসূত, মনের জ্বালা মেটানোর ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র।


জাবিরের অবদান অবশ্য ফেইথ ফ্রিডম অস্বীকার করেনি। কিন্তু জাবিরকে তারা নন-প্রাকটিসিং মুসলিম বলে দাবী করে, প্রশ্ন উঠিয়েছে, "জাবেরের ধর্মীয় চেতনার সাথে একমত না হওয়া সত্ত্বেও মুসলিমরা কেন জাবেরকে নিয়ে গৌরব বোধ করে এবং তাকে মুসলিম বিজ্ঞানী হিসেবে দাবী করে?"

জাবেরকে নিয়ে মুসলিমরা গৌরব বোধ করার মূল কারন রসায়ন শাস্ত্রে জাবেরের অবদান। আর শুধু মুসলিমরাই গর্ব বোধ করেছেন, এই দাবীও পুরো সত্য নয়। যা হোক, মূল প্রসংগ হচ্ছে: ফেইথ ফ্রিডমের দাবী জাবের আসলে মূলধারার মুসলিম ছিলেন না - এটা কতটুকু সত্য?

জাবের ৮০০ শতকের একজন বিজ্ঞানী। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তার সম্পর্কে খুব নিশ্চিত করে কিছু জানা যায় না। জাবেরের বিষয়ে যে বিষয়টি ইতিহাসবিদদেরকে সন্দিহান করে তুলেছিল তা হল জাবেরের রেখে যাওয়া বিশাল গ্রন্থভান্ডার। এত গ্রন্থ একজনের পক্ষে লেখা কি আদৌ সম্ভব - এই প্রশ্ন থেকেই জাবের হয়ে থাকেন এক রহস্যাবৃত ব্যক্তি। ধীরে ধীরে নিরন্তর গবেষনার ফলে জাবের সম্পর্কিত রহস্যের জট খুলতে থাকে। জাবেরের গ্রন্থের পাশাপাশি ল্যাবরেটারী এবং সেখানে রাখা মর্টার পাওয়া যায়। ইতিহাসবিদরা এসব নিদর্শন থেকে ঘটনাপ্রবাহের সূতো গাথতে থাকেন। কিন্তু সে ইতিহাস কখনই অনিশ্চয়তার ছাপমুক্ত ছিল না। যতটুকু জানা যায় তাতে জাবেরের মূলধারার ইসলামের প্রতি আসক্তি ও বিশ্বাস বেশ ভাল ভাবেই ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। জাবের ছিলেন প্রখ্যাত শিয়া ফকীহ এবং ইমাম জাফর সাদিকের শিষ্য (http://en.wikipedia.org/wiki/Ja'far_al-Sadiq)। জাবেরের লেখা গ্রন্থে ইমাম জাফর সাদিককে "মাস্টার" বলে সম্বোধন করা হয়েছে। জাফর সাদিক শিয়া হলেও সুন্নীদের মাঝে গ্রহনযোগ্য ইসলামী ব্যক্তিত্ব। জাফর সাদিকের শিষ্যের মধ্যে রয়েছেন ইমাম আবু হানিফা, যিনি সুন্নীদের হানাফী মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা, মালিক ইবনুল আনাস, যিনি মালিকি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং ওয়াসিল ইবনুল আতা, যিনি মুতাজিলা মতবাদের জনক। ইমাম জাফর সাদিক মতবাদের উপরে সর্বস্তরের কাছে গ্রহনযোগ্য একজন ব্যক্তিত্ব। সেজন্য শিয়া মতবাদের হওয়ার জন্য কেন জাবের ইবনুল হাইয়ানকে সাধারন মুসলিমদের থেকে ভিন্ন মতাদর্শের হতে হবে, তা বোধগম্য নয়। শিয়াদের বিভিন্ন বইতে জাবেরকে ইমামের একজন ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে দেখানো হয়েছে। একজন নন-প্রাকটিসিং মুসলিম কেনই বা ইমাম জাফর সাদিকের মত একজন উচুস্তরের ইসলামী ব্যক্তিত্বের ঘনিষ্ঠ ও স্থায়ী সাহচর্য পাবে, সেটা মোটেও বোধগম্য নয়। সুতরাং ফেইথ ফ্রিডম কিসের উপর ভিত্তি করে জাবেরকে ভিন্ন চেতনাধারী দাবী করছে, তা বোঝা গেল না।

একটা ব্যাখা হতে পারে ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের দ্বারা জাবের ব্যবহৃত হয়েছেন। জাবেরের নাম করে ইসমাইলিয়ারা নিজেদের লেখা চালিয়েছে। সেজন্য মনে হতে পারে জাবের বুঝি ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের একজন। কিন্তু সেটা তো অসম্ভব, কারন ইসমাইলিয়া মতবাদের জন্ম হয়েছে জাবেরের পরবর্তী কালে। এছাড়া যেসব বই জাবেরের লেখা বলে ধারনা করা হয়, তাতে কোথাও ইসমাইলিয়া বা সে জাতীয় মতবাদের প্রভাব দেখা যায় না। জাবের শিয়া ছিলেন, যিনি ইমাম জাফর সাদিকের ঘনিষ্ঠ সহচর - ইতিহাস সেদিকেই জোরালো ইংগিত দেয়। কিছুটা সুফী ভাব জাবেরের মধ্যে ছিল, তবে এটাও সম্ভবত ইমাম জাফর সাদিকের প্রভাবে প্রভাবিত হবার জন্যে। তবে জাবেরের ধর্ম দর্শন নয়, ইসলামী জ্ঞানচর্চা নয়, বরং মূল অবদান রসায়ন শাস্ত্রে - সেটা অনস্বীকার্য।

=========================================

3 comments:

HJKL said...

বাহ!!!! অসম্ভব সুন্দর একটা লেখা!!!! অনেএএএএএএএএক অজানা কিছু জানা গেল.............. আসলেই, অসম্ভব সুন্দর লেখা.........

এধরনের লেখা আরো চাই আপু...........

Unknown said...

Nice

Jahirul Islam said...

এটা এ সম্পর্কে দুই মিনিটের একটি ছোট ভিডিও। দেখতে লিঙ্কটাতে ক্লিক করুন।

https://youtu.be/7OpCUTjVa-0